“বাবা, তুমি হারানো দিনের মতো হারিয়ে গেলে। দেখতে দেখতে দু’টি বছর “তুমিবিহীন” অতিবাহিত হয়ে গেল।”
মানুষকে আল্লাহ অফুরন্ত নিয়ামত দান করেছেন। সেই অসাধারণ সুন্দর নিয়ামতের একটি সন্তানের জন্য তার মা-বাবা। বাবা সন্তানের মাথার ওপর যার স্নেহচ্ছায়া বটবৃক্ষের মতো, সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে হয় তাঁকে, আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা হলো বাবা। বাবার তুলনা বাবাই। যার কল্যাণে এই পৃথিবীর রূপ, রং ও আলোর দর্শন। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন। বাবাকেই আদর্শ মনে করে সন্তানেরা। বাবা সন্তানকে শেখান কীভাবে মাথা উঁচু করে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়।
আজ বাবা আমাদের মাঝে নেই। আজ ২ বছর বাবা ছাড়া। বাবা চলে যাওয়ার পর শিখেছি অনেক বাস্তবতা, দেখেছি অনেক নিষ্ঠুরতা।
‘আমার আব্বা’—এই দুটি শব্দের মধ্যে নিহিত আছে বাবার জন্য আমার বলা না-বলা যত আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, গর্ব; তাঁকে হারানোর কষ্ট আর অশ্রু। আব্বা আমাদের কাউকে কিছু না বলে, কাউকে কিছু করার কোনো সুযোগ না দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আর কখনো আব্বার সঙ্গে দেখা হবে না, কথা হবে না এটি আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। খবরটা শোনার পরও বিশ্বাস করিনি, ভেবেছি কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে কি না।
জীবন বহমান। সকল হারানো কিংবা শোক-তাপের ঊর্ধ্বেও জীবন স্বীয় গতিতে চলবে। এটাই চিরন্তন সত্য। স্মৃতি শুধুই স্মৃতি। কিছু স্মৃতি বড়ই বেদনাদায়ক। কিন্তু স্মৃতিকে যেমন ভুলে থাকা যায় না, তেমনি অস্বীকারও করা যায় না। আমি জানি, আমি আমার বাবাকে কতটা ভালোবাসি। কিন্তু আজ আমার সেই ভালোবাসা আমি কাকে প্রদর্শন করব? কাকে আমি সেই প্রিয় ‘আব্বা’ বলে ডাকব? আমার ভাগ্যবিড়ম্বিত এই আক্ষেপ অন্তরের। এই জ্বালা কি কোনো দিন নিভবে?
আহ! আজ দিন চলে গেছে। আমি আব্বাহীন অসহায়। আমার পথের চার দিক তিমিরে ঘেরা। আমাকে আপন করে আর কেউ ভালোবাসে না। আব্বার মতো মমত্ব নিয়ে কেউ তো আর এল না এ জীবনে। কেউ আর আব্বার মতো নিঃস্বার্থ ভালোবাসে না। সবার ভালোবাসার ভণিতার মাঝে স্বার্থ কাজ করে। সবাই ভালোবাসার অভিনয় করে বিনিময়ে কিছু নিতে চায়। কিন্তু বাবা, তোমরা তো কিছু নিতে চাও না, শুধু দিতে চাও। বাবা আমার খুব আবেগী ছিলেন। আমাকে খুব শাসন করতেন। খুব আদর করতেন। পৃথিবীতে এমন কোনো ভাষা নেই, এমন কোনো সাহিত্য নেই, যা দিয়ে আমার মনের এ ক্ষতকে প্রকাশ করতে পারব। এমন কোনো সান্ত্বনার বাণী নেই, যা শুনিয়ে আমার বুকের মাঝে পাথরচাপা কষ্টগুলোকে কমানো যাবে। আমার বাবা নেই। আমার বটবৃক্ষ নেই। যে আমার জন্ম থেকে তার শীতল ছায়া দিয়ে বড় করেছে। এখন গ্রীষ্মের দাবদাহে আমার গা পুড়ে ছারখার হবে। কেউ আর বটবৃক্ষের ছায়া নিয়ে আমার পাশে দাঁড়াবে না। কেউ না। আমি সূর্যের তেজে মোমের মতো গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যাব ধীরে ধীরে।
আব্বা থাকতে মনে হতো না আমি বড় হয়েছি, মনে হতো এখনো ছোট আছি। এখন মনে হয় বয়স হয়েছে, নিজেরই বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আব্বা হারানোর ব্যথা বা আব্বাহীন জীবনের কষ্ট ভয়ানক। যে বাবা হারায়নি, সে এই ব্যথা বুঝবে না। আমার আব্বা অনেক সময় আমাকে বলতেন, তুমি খুব আবেগপ্রবণ, হুজুকে চলো, বাস্তববাদী না, ঠিক সময় ঠিক কাজ করতে পারি না, যার কারণে অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয়। তাই মাঝেমধ্যে বকা শুনতে হতো।
আব্বা আমাদের জন্য তাঁর আদর্শ রেখে গেছেন। না, আদর্শ মানে গালভরা কিছু নয়। সামান্য নিয়েও সততার শক্তিতে আর ভালোবাসায় কীভাবে সবকিছু কানায় কানায় ভরিয়ে রাখা যায়, এ শিক্ষা তো দিয়ে গেছেন। ছোট্ট একটা জীবন আনন্দময় করার জন্য সততার চেয়ে বড় আদর্শ আর কী হতে পারে।
আব্বা, আজ তুমি নেই, আজ তুমি ছাড়া আমরা যে কী অসহায়, তা বুঝতে ভুল হয় না একটিবার। তুমি ছিলে আমাদের প্রাণ আর আমিও ছিলাম তোমার প্রাণ। আল্লাহ, আমার আব্বার সব পাপ মাফ করো, কবরের আজাব মাফ করো, তার রুহের শান্তি দাও, তাকে জান্নাতবাসী করো।
‘হে আমার রব! তাঁদের প্রতি দয়া করো যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাদের প্রতিপালন করেছিলেন।’