শেষ-পর্ব
ভূয়া কোম্পানির এক্সিকিউটিভ
হারুন আল রাশিদ
গাড়িতে উঠে বসলাম। কিছুক্ষণ পরেই ছেড়ে দিলো গাড়ি। আমি জানালার পাশে। নিরস মন। চোখ বাইরের দিকে। এই প্রথম প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে বেমালুম মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বিশাল বিশাল বাগানের পাশদিয়ে ছুটতে লাগলো গাড়ি। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছি। কি সুন্দর সাজানো-গোছানো পরিপাটি গাছ গাছালি! রাব্বুল আলামিনের নিখুঁত সৃষ্টির নিপুণতায় বিস্ময়াভিভূত হৃদয়ের একূল ওকূল। বারবার মনে হলো কোম্পানি ভূয়া হোক আমার এই অভিজ্ঞতার মূল্য কোটি টাকার চাইতে বেশি। যদি না আসতাম,অপূর্ণই থেকে যেতো মুগ্ধতার কাঁচের গ্লাস।
রাজ নারায়ণপুর নামলাম। ঢুকলাম একটা বড়সড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। কিছুক্ষণ মালিকের সাথে কথা বললাম। স্যাম্পলগুলো দেখালাম। মালিক মনযোগ দিয়ে দেখলেন। মালের ব্যাপারে তার বক্তব্য শামসু ভাইর অনুরূপ। আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। বলা যায় পুরোপুরি। রাসেদের কথা চিন্তা করে চুপ মেরে রইলাম। বেচারা বড় গলা করে আমাকে নিয়ে এসেছে। কে জানতো পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যাবে! অন্য দোকানে যাওয়ার ইচ্ছা-আগ্রহ কোনোটাই অবশিষ্ট নেই। ভেতরে-বাইরে ফিরে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হতে লাগলো।
দুপুর নাগাদ চলে এলাম বাড়িতে। গাড়িতে বসেই রাসেদ সন্ধ্যার পরের পরিকল্পনা ব্যক্ত করলো। বুঝতে পারলাম আমার ভাঙা মনকে চাঙা করার জন্যই কিঞ্চিৎ বিনোদনের ব্যবস্থা। পরিকল্পনাটা ছিলো যাত্রা দেখার। কলের বাজারের কাছাকাছি যাত্রা পার্টি এসেছে। খুব সুন্দর করে প্যান্ডেল সাজিয়েছে। আসার সময় কয়েকজনকে জোরেসোরে কাজ করতে দেখেছি। বিকেল গড়ালেই সব কাজ গোছানো হয়ে যাবে। সন্ধ্যার পর পরই শুরু হবে আপন দুলালের পালা।
দুই পাশে ঢালা বিছানা। একদিকে বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেঞ্চে বসলে বিশ টাকা। হোগলা বিছানায় দশ টাকা। আমরা কম টাকায় ঢালা বিছানাই বেছে নিলাম। একেবারে প্যান্ডেলের সামনাসামনি। আমাদের অনুসারীর সংখ্যাই বেশি।
নয়ন তারা’র নাচ দিয়ে যাত্রা শুরু হলো। চারদিকে নিরব গুঞ্জন। পালা শুরু হয়ে গেছে। শিল্পীরা যার যার পাঠ অনুযায়ী অভিনয় করে যাচ্ছে। দর্শক সেন্টিমেন্ট অনুধাবন করে বুঝতে পারলাম, অভিনয়ের চাইতে নাচের দিকেই প্রবল আগ্রহ। কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরে বারবার মাইকে ঘোষণা করছেন,’ একটু পরেই উপভোগ করবেন সুন্দরী, লাস্যময়ী, যৌবনাবতী, মৌবন মক্ষী সেলিনা পারভীনের ঝাকানাকা নাচ।’ সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। আমি মাথা উঁচিয়ে চারদিকটা দেখতে লাগলাম। বামপাশের এক টেবিলে তিনটা মেয়েকে দেখলাম থুতনির নিচে হাত রেখে বসে আছে। রাসেদকে ইশারা করলাম। মাথা ঝাঁকি দিয়ে বললো, ‘দাঁড়ান, ব্যবস্থা করতেছি।’ তখনো আমার মাথায় ঢোকেনি রাসেদ আসার সময় ছোট্ট একটা পলিথিন কেনো সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো।
জণগণের তর সইছে না। বারবার নাচ প্রদর্শনের জন্য চিৎকার, চেঁচামেচি করতে লাগলো। অবশেষে চলে এলো কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। সেলিনা পারভীন সারা শরীর মেকআপ করে স্টেজে এলো। পরনে হাতাকাঁটা ব্লাউজ। চলতে গেলেই টসটসে উঁচু বুকের থৈথৈ দুলুনি। বুকের সামনের বড় একটা অংশ আবরণ মুক্ত। ঢোল, তবলা, হারমোনিয়াম, ডুগডুগিসহ অনেকগুলো বাজনার সমন্বয়ে পুরনো দিনের খ্যামটা গান উচ্চস্বরে বাজতে লাগলো মাইকে” রূপে আমার আগুন জ্বলে–যৌবনভরা অঙ্গে।” নাচনেওয়ালি তাল অনুযায়ী পেখম পেখম নাচে সাধ্যমতো নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করছে। অনেকটা বিচ্ছিরি রকমের অঙ্গভঙ্গি। আকাশের দিকে মুখ করে, মাথাটা যতটা সম্ভব নিচে নামিয়ে, চুল মাটিতে ঠেকিয়ে, দুই হাত প্রসারিত করে, উল্টে যাওয়া ব্রেস্ট দুটো মেঘনা নদীর শান্ত ঢেউয়ের মতো দোলায়িত করতে লাগলে। লোকজনের সে কি উল্লাস! বুকের কিমাকার মাংসপিণ্ড দুটি একটু পরপর দর্শক অভিমুখে স্বেচ্ছায় লম্বা ঝাঁকি দেওয়ার দৃশ্যে মাতোয়ারা পাবলিক।
গরম ভাপা পিঠার রসালো নাচে দর্শক হৃদয় মথিত হলেও ভিন্ন সমস্যা দেখা দিলো। নাচনেওয়ালির বাঁ পায়ের অপেক্ষাকৃত শক্তিহীনতা সবার চোখেই আটকা পড়লো। বিভিন্ন ভঙ্গিতে কিছুতেই দু’পায়ের সামঞ্জস্য হচ্ছে না। একজন বললো, ‘মাগী মাসিকের সমস্যা লইয়া নাচতে আইছে।’ পাশেরজন বললো,’মনে হয় নাচতে আহনের আগে লাগাইয়া আইছে।’ কেউ কেউ বললো,’দুই,তিনজনের লগে সমানে লাগাইছে।’ এরকম রাবিশ কথা-বার্তা শুনছি স্টেজের দিকে চোখ রেখেই। হঠাৎ রাসেদ পলিথিন বের করে আমাকে বললো,’ আপনি সামনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমি পলিথিনে হিসু করবো।’ প্রসাব করা হলে পলিথিনে গিট্টু মেরে হাতে নিয়ে বসে থাকলো। তারপর বারকয়েক ইতিউতি তাকিয়ে বেঞ্চে বসা মেয়েদের দিকে ছুঁড়ে মারলো। দূর থেকে শুনলাম একটা মেয়ে বলছে,’ কোন্ হারামি জানি পানি ফিক্কা মারছে।’ আরেকটায় বলছে,’বুজি গো বুজি, কেমনজানি গন্ধ গন্ধ কয়।’ বিষয়টা বড় রকমের খারাপ হলেও আমার খুব আনন্দ লাগছিলো। কিছুতেই হাসি চাপা দিয়ে রাখতে পারছি না। শেষে রাসেদকে অনুরোধ করে যাত্রা পালা সমাপ্তির আগেই প্যান্ডেল থেকে বের হয়ে এলাম।
তরিনো
ইতালি