একবার সারাবিশ্বে একটা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লো, মনে আছে তোমাদের? কোভিড-১৯ ছিলো সেটি। তখন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছিল। সবাই ঘরে থাকে। বাইরে বের হলেই পুলিশ আর করোনায় ধরে। এমন একটা আতঙ্কে আমরা ঘরবন্দী হয়ে গেলাম। ঠিক সেই সময়। আমাদের বাসার এক ভাড়াটিয়া রংপুর থেকে এসেছিলো বলে, লকডাউন করা হলো আমাদের বাড়ী। কী যে অশান্তি। স্কুল, কলেজ বন্ধ হয়ে গেলো। বাস চলছে না।
আমার দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। একদিন মনে মনে বুদ্ধি করলাম। রাতে বের হবো। লকডাউন হওয়ায় আমাদের বাড়ীর কারো সাথেই মহল্লার কোনো মানুষ মিশছেনা। কোন বন্ধু-বান্ধবেরও দেখা নেই।
অগত্যা একাই বের হলাম। সাইকেল চালিয়ে সোজা চলে গেলাম কিটিংচর। এটি সিঙ্গাইর থানার একটি ছোট্টগ্রাম। সিঙ্গাইর থানাটা চিনলে না? এই থানারই পারিলগ্রামে শহীদ রফিক উদ্দীন আহমদ জন্মেছেন। আহা! তবুও চিনলে না? চিনবে চিনবে। একটু সবুর করো, বলছি। এটি হলো, মানিকগঞ্জ জেলার কিটিংচরের কথা বলছি। কিটিংচর গ্রামের ভিতর দিয়ে একটা রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে মানিকগঞ্জ সদরে। এই রাস্তাতেই একটি ব্রীজে সাইকেল থামিয়ে বসে আছি।
তখন রাত বারোটা বাজে। পুলিশের গাড়ী একবার সাঁই করে চলে গেলো। থামলো না। আর কোন গাড়ী নেই। মানুষ নেই, পশুও নেই।
সুনসান নিরব। কেউ কেউ এই নিরবতাকে পিনপতন নিরবও বলে। বাতাসের শব্দও অনুভব করা গেলো না। আমি ব্রীজের রেলিংএ হেলান দিলাম। ভালোই লাগছিলো। হঠাৎ একটা বুড়োমত লোক এলো। কোন দিক থেকে এলো বুঝতে পারলাম না। অনেকটা আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। আচমকা দেখেই চমকে উঠলাম। বললাম, চাচার বাড়ী কোথায়।
–কিটিংচরেই।
-এতো রাতে বাইরে বের হলেন যে?
আমিতো বাইরেই থাকি।
—-কী বলেন, বাইরেই থাকেন মানে?
—হ,এই ঘুরাফিরা করি আর কি।
—তোমার বাড়ী কই?
—-হেমায়েতপুর।
—এতোদুরে আইছো, ঘুরতে? আইছো ভাল, চলো আজ সারা রাত এক সাথে ঘুরবো।
আমি সম্মতি জানালাম। এতো রাতে একজন কথা বলার মানুষ পেয়ে খুব ভালো লাগছিলো।
লোকটি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললো, চলো যাই।
—কোথায়?
—সাইকেল চালাও, আমি পিছনে চড়ি। পারবাতো চালাতে?
–হ চাচা, পারবো, বলে আমি চালাতে থাকি। সে পিছনে বসে আছে।
কিছুদূর গিয়ে বললো, থামো। তোমার ক্ষিদে পায় না?
–হ্যাঁ, ক্ষিদে পায়তো।
–কিছু খাবে?
–এতো রাতে খাবার কোথায় পাবো চাচা?
—আমি ম্যানেজ করছি। কিš‘ একটা শর্ত আছে।
—আবার শর্ত কিসের?
—-তোমাকে গাছে উঠতে হবে।
—গাছে উঠতে হবে মানে? বুঝলাম না চাচা?
পাশের একটি বটগাছের দিকে ঈশারা করে বললো, ‘ওটিই আমার বাড়ী।’
— আশ্চর্য! ওটি আপনার বাড়ী মানে?
—আপনি কে?
–আমি এই রাজ্যের রাজা। রাজা হরগোবিন্দ।
আমি হো হো করে হেঁসে বললাম, রাজা হরগোবিন্দ না হরগোবিন্দ দাশ?
শুধু ফান করেন, না?
—ফান নয় ছেলে, আমি ভূত রাজ্যের অধিপতি। বটবৃক্ষে আমার আসন। আমি ওখানে বসে বসে এই ভূতরাজ্য শাসন করি।
আমার কথা বিশ্বাস না হলে চলো, স্বচোখ্যে দেখে আসবে আমার পরিচয়।
—-না চাচা, আমি গাছে উঠতে পারবো না।
—গাছে যে তোমাকে উঠতেই হবে। একমাস লকডাউন চলছে। কোন মানুষের দেখা আমি পাই না। আজ তোমাকে যখন পেয়েছি, তখনতো গাছে না উঠিয়ে ছাড়ছিনা।
—কী যে বলেন চাচা! গাছে উঠিয়ে কী করবেন শুনি?
—-ওখানে নিয়ে তোমাকে মিষ্টি খাওয়াবো। তারপর, তোমার ঘাড় মটকে শরীরের সবটুকু রক্ত শুঁষে নেবো। রক্ত ছাড়া আমার চলে না। এক মাস কিছু খাইনা।
—হো হো হো করে একগাল হাসি ছড়িয়ে দিলাম। আর শরীরের সমস্ত শক্তি উজার করে দিয়ে একটা লাথি দিলাম চাচাকে।
চাচা গড়িয়ে গড়িয়ে খালের ভিতরে চলে গেলো। মুখ খুসে পড়ে আমাকে বলছে,’ তোরতো সাহস কম নয়রে বাছা! এমন একটা লাথি দিলি? আমি একটা মাসের উপোস। শরীরটা খুব দুর্বল তাই তুই পারলি খালে ফেলতে। নইলে তোকে আজ দেখেই নিতাম। ইতোমধ্যে একটি পুলিশের গাড়ী এলো। চারপাঁচজন পুলিশ আমাকে ঘিরে ফেললো।
একজন এএসআই খপ করে আমার হাত ধরে বললো, ‘তুই এতো রাতে এখানে। কী করছিস? বললাম, ‘ভূতের সাথে গল্প করছি।’
–কই ভূত কই?
—ওই যে লাথি মেরে খালে ফেলেছি। দুইজন পুলিশ ভূত চাচার কলার ধরে রাস্তায় উঠিয়ে আনলো।
— এ এস আই চাচাটিকে প্রশ্ন করলো, ‘ তোমার বাড়ী কোথায়?’
—এইতো কিটিংচরের বটগাছে।
হাতে থাকা লাঠি দিয়ে সপাংসপাং কয়েকটা আঘাত করলো, চাচার পাছা বরাবর। আর বললো, ‘ কিটিংচরের বটগাছে আমাদের রাজা মশাই থাকে। তুই মিথ্যেবাদী ভূত!
—-হ্যাঁ, আমিইতো তোমাদের রাজা হরগোবিন্দ!
—-কী! পুলিশ চমকে উঠলো। ‘ আপনার এই হাল কেনো?’
—আমি লকডাউনের এক মাস অভূক্ত। কোন খাবার নেই। তাই ভাবলাম এই ছেলেটার রক্তটুকু খাবো কিন্তু ও আমাকে কষে একটা লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে।
আমি ভাবছি এরা কী সব বলছে! তাহলে কী সত্যিই আমি বিপদে পড়ে গেলাম?
পুলিশ বললো, রাজা মশাই চিন্তা করবেন না। লকডাউনে আপনি ভূত রাজ্যের কোন খবরই নেননি। আমরা খেয়ে না খেয়ে ডিউটি করছি। আমাদেরকে মাফ করবেন। এই ভূতের ব্রীজ অর্থাৎ গলাকাটা ব্রীজের রাজত্ব নিয়ে আপনি ভালোইতো রাজত্ব চালা”িছলেন।
ব্রীজটিকে গলাকাটা ব্রীজ নামে সবাই চেনে। আমি কখনোই শুনিনি এটি একটা ভূতুড়ে ব্রীজ। ভূতের রাজত্ব এখানে কায়েম আছে। এখান থেকে বাঁচার কোন উপায় পা”িছ না।
—চাচা বললো, ‘আমার রাজত্বে কোনো অভাব ছিলোনা। তোমাদের পুলিশদের বেতন ভাতারও কোন সমস্যা ছিলোনা। শুনছি দেশে কোভিড১৯ নামক ভাইরাসটি ভূতের চেয়েও বেশি চালাক। বারবার তারা রূপ পরিবর্তন করে। ফলে বিজ্ঞানীরাও মহাবিপদে আছে। বিজ্ঞানীরাতো এক সময় আমাদের অস্তিত্বই বিলীন করে দিয়েছে। মানুষ এখন আমাদের দেখে ভয় পায় না। অথচ কোভিড-১৯ এর ভয়ে ঘরবন্দী হয়ে আছে। কাজ কর্ম ছেড়ে দিয়েছে। বুঝতে পারছি আমাদের রাজত্ব ধীরেধীরে শেষ হয়ে আসছে। আমরা সদলবলে মারা পড়বো।
— এএসআই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, তাইই তো দেখছি রাজা মশাই। চলুন আমরা কিটিংচর এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই।
—ঠিক বলেছো এএসআই। তোমরা পুলিশরা সবাই আসো, রাজ্যের সকল সদস্যকে ডাকো আর ঘোষনা করে দাও। ‘ আমাদের আর কিটিংচরে থাকা হচ্ছে না। দূরের কোনো বনে চলে যাই।
আমি বললাম, তোমরাতো বনে যাচ্ছো, সেখানেও মুশকিল আছে। মানুষ গাছ কেটে বন-জঙ্গল উজার করে দিচ্ছে।
—রাজা হরগোবিন্দ বললো, ‘আমরা সুন্দরবনেই যাবো।
—বললাম, সেখানেও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হচ্ছে। ধোঁয়াতে বনবৃক্ষও উজার হবে।
–রাজা হরগোবিন্দ বললো,’ তাহলে আমরা গভীর সাগরের দিকে যাবো। আর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘তুমি বাসায় চলে যাও। আজ তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম।