আসুন আব্দুল লতিফদের পাশে দাঁড়াই
মাহমুদ শরীফ: শ্রষ্ঠার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের জীবনে চাহিদার শেষ নেই। এজন্য শুধু চাই আর চাই! আর এই চাহিদা বা চাওয়াকে পূরণ করতে যেয়ে মানুষের কতই না কসরত। রাতদিন খেটে চলেছে, বৈধ অবৈধ পন্থায় চাহিদা মেটানোর জন্য বা সম্পদের মোহে পার্থিব সুখের আশায় পরকালের করছে সর্বনাশ। এই চাহিদা চিরন্তন, এর সমাপ্তি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তবে পরহেজগার বান্দাদের বেলায় এটা যদিও খাটানো অযৌক্তিক বৈকি!
মানুষের এই চাহিদা বা এটা নেই, সেটা নেই – এর ভূবনে আজ এমন একজন মানুষের তথ্যদী বর্ননা করছি, যার কিছুই নেই। হাঁ, এবার বলছি বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলা শহরের পূর্ব পাড়ার এক বনি আদমের কথা। নাম আব্দুল লতিফ। বাক প্রতিবন্ধী, কথা বলতে পারেনা। মনের অব্যক্ত কথাগুলো বলতে না পেরে তার যে কী কষ্ট আর যন্ত্রণা সেটা আমাদের মত স্ববাক মানুষের উপলব্ধি করার কথা নয়। শুধু তাই নয়, শ্রবন শক্তিও নেই আব্দুল লতিফের। পিতা-মাতার দেয়া চমৎকার অর্থবহ নিজের নাম ‘আব্দুল লতিফ‘ শব্দটিও সে কোনদিন শুনতে পায়নি। ইশারা ইঙ্গিতের ভাষায় তাকে স-ব কিছু বুঝে নিতে ও অন্যকে বোঝাতে হয়েছে দূর্বিসহ জীবনে। অবহেলিত আব্দুল লতিফের চল ফেরা,র ক্ষমতাও নেই। শারীরিক প্রতিবন্ধী সে। যেন একটি রক্ত মাংসের অচলপিন্ড। কোথাও যেতে হলে অন্যের সাহায্য ছাড়া কল্পনাও করা অসম্ভব। তাকে টানবে বা সাহায্য করবে কেউ, সেটাও স্বপ্ন। কেননা আব্দুল লতিফের কোন সহায়-সম্পত্তি নেই যে! রাতে মাথা গোঁজার মত শুয়ে ঘুমানোর আশ্রয়ও নেই তার। গৃহহীন সে। ঘর না থাকায় যাযাবর কুকুরের মত যেখানে রাত, সেখানে-সেভাবেই কাত হয়ে ঘুমিয়ে যায় আব্দুল লতিফ।
কিছু না থাকলেও একটি জিনিস আছে এই অসহায় জন্ম প্রতিবন্ধী মানুষটির। আর সেটা হচ্ছে-ক্ষুধা। এই ক্ষুধা নামের দানবের কাছে অসহায় সকল প্রাণী। আব্দুল লতিফও এর বাইরে নয়। পেটের জ্বালা নিবারনের জন্য শব্দহীন হাউমাউ করে কাঁন্নাকাটি করতেও পারেনা আব্দুল লতিফ। সমাজের জনপ্রতিনিধি, সমাজকর্মী, আমলা কেউই বিষয়টি না বুঝলে অন্যের বাড়ী ঝিয়ের কাজ করে খাওয়া, দিনমজুর দূর্বল শরীরের একমাত্র ভাইয়ের স্ত্রী বাধ্য হয়েই এগিয়ে আসে আব্দুল লতিফের সাহায্যে। ‘মরা না ফেললে গন্ধে মরতে হবে‘ এমনটি মনে করে হলেও ভাবি দেখভাল করে তার। হতদরিদ্র সংসারের বোঝাকে নিয়ে দূর্ভোগের শেষ নেই। পেটের চাহিদার তাগিদে আব্দুল লতিফকে বাধ্য হয়েই ভিক্ষার থালা ধরতে হলো। কিন্ত এখানেই কী স্বস্তি আছে? হাত পাতবে কীভাবে সে? চলার ক্ষমতা নেই তার। এখানেও ভাবীজান আব্দুল লতিফের অন্ধের যষ্টি। ভাবীর কাঁধে উঠে সে রাস্তার মোড়ে যেয়ে বসে। হাতের ইশারা ইঙ্গিতে পথচারীদের কাছে শুধু পেটে খাওয়ার জন্য সাহায্য চায় সে। বিলাসীতা কিংবা সম্পদ জমানোর মোহ কী জিনিস সেটা বোঝেনা এই হতভাগা মানুষটি। ভিক্ষা থেকে পাওয়া অর্থই আব্দুল লতিফের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। শরীরে নানান রোগ বাসা বেঁধেছে আব্দুল লতিফের। রোগাক্রান্ত হওয়ায় মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে বসার শক্তিও থাকেনা তার। দরিদ্র ভাই-ভাবীর সংসারে নুন আনতে পান্তা পুরোই, তবুও ফেলে দিতে পারে না ভাইকে। সাথে রাখে খেয়ে না খেয়ে। একটি বয়স্ক কিংবা প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ডের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে বার বার যেয়েও ব্যর্থ ভাই-ভাবি। এই চরম অসহায় আব্দুল লতিফ ও তার এমন দূর্বিসহ জীবনযাপনের বিষয়টি সোস্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরেন এলাকার জনহিতৌসী যুবক মুমিন মনির। বিষয়টি সুদুর লন্ডনে বসে প্রত্যক্ষ করেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা ‘আর্ণ এন্ড লিভ‘র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মানবদরদী, মমতাময়ী নারী ফরিদা ইয়াসমিন জেসি। ‘ফ্রেন্ডস আর্ণ এন্ড লিভ‘র ধারাবাহিক কার্যক্রমে আব্দুল লতিফের পাশে ত্রাণকর্তা হয়ে এগিয়ে আসেন সবার শ্রদ্ধেয় জেসি আপা। তিনি ‘আর্ণ এন্ড লিভ‘র জয়পুরহাট টিমের সহায়তায় প্রথমে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেন আব্দুল লতিফের। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বসত ঘরটি তৈরিতে সার্বিক তত্বাবধানে ছিলেন রবিন, রনি, আসলাম, মোহন, তুহিন, রাজু, জিহাদ প্রমূখ। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে দোয়ানুষ্ঠান ও মিষ্টি বিতরনের মাধ্যমে নতুন পোষাকে অসহায় আব্দুল লতিফকে নতুন ঘরে তুলে দেয়া হয়। এসময় তার খাবারের ব্যবস্থাও করে ‘আর্ণ এন্ড লিভ‘। আর যাতে অন্যের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করতে না হয় সে জন্য প্রতি মাসে হাজার টাকা ভাতাও চালু করা হলো। এভাবে বেশ কয়েক মাস অসহায় আব্দুল লতিফের জীবনে পাশে থাকে ‘আর্ণ এন্ড লিভ‘।
অবশেষে! অবশেষে জীবনযুদ্ধের মহাসমাপ্তি। আব্দুল লতিফের জীবনও এর ব্যতিক্রম নয়, বন্দ হয়েছে স-ব কোলাহল। থেমে গেছে সব কিছু! আব্দুল লতিফের জীবনের প্রদীপ নিভে গেছে গত ৬ জুলাই বৃহস্পতিবার। মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে সে পরকালের যাত্রী হয়েছে। ইহকালীন জীবনের স্বাদ না পাওয়া প্রতিবন্ধী আব্দুল লতিফের শেষ যাত্রায়ও শামীল হয়েছিল ‘আর্ণ এন্ড লিভ‘। তার জন্য দোয়ার আয়োজনও করা হয়।
আব্দুল লতিফ নেই, পড়ে আছে সেই ঘর, বিছানা, পোষাক, আসবাবপত্র —। স্মৃতি হয়ে আছে তাকে নিয়ে ‘আর্ণ এন্ড লিভ‘ এর উদ্যোগ আর কর্মসূচি বাস্তবায়নের ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ! ওপারে আব্দুল লতিফ ভালো আছে, ভালো থাকবে এটাই কামনা। এক আব্দুল লতিফ পরপাওে গেলেও হাজারো আব্দুল লতিফ আজও অসহায়। তারা চেয়ে আছে আমাদের দিকে অধীর আগ্রহ নিয়ে।
আসুন চারপাশের অবহেলিত এখনো যে সব আব্দুল লতিফ বেঁচে আছে তাদের পাশে দাঁড়াই। মানবতার কল্যাণে এগিয়ে আসি। আর এমন আব্দুল লতিফদের পাশে দাঁড়ানোর এই মহাদায়ীত্ব শুধু সরকারের নয়; আমার, আপনার, সবার।