কাজী নজরুল ইসলাম : বাঙালির পথ ও পাথেয়
–ওয়াজেদ বাঙালি
ভালো কবিকে নিয়ে কিছু কালো কথা ইতিহাসে অঢেল। কাজী নজরুল ইসলাম(১৮৯৯-১৯৭৬)এর ব্যতিক্রম নয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে একজন মুসলিম লেখক বিতর্কিত হবে না, এটা ভাবা বোকামি। কিছু আস্তিক, বেশ কিছু নাস্তিকের শরীরে সব সময়ই নজরুল নামে এলার্জি ওঠে।আর নজরুল যে সচেতন পাপের অপরাধী কিয়ামত তক সেই এলার্জি উঠ তেই থাকবে। অন্নদা শংকর রায় নজরুল ভাগ হইনি বলে এক সময় গৌরববোধ করেছিলেন।
তিনি লিখেছিলেন,
ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নি কো নজরুল।
এই ভুল টুকু বেঁচে থাক,
বাঙালি বলতে একজন আছে
দুর্গতি তার ঘষে যাক।
ছোটবেলা থেকে আরেকটি ছড়া শুনে আসছি। কে লিখেছেন জানি না,
নজরুল
তুমি করিয়াছো মস্ত বড় ভুল
দাড়ি না রেখে
রাখিয়াছ ইয়া বড় চুল।
নজরুল কখনও ভাগ হয়নি। কিন্তু ভারতের সমাজ সংস্কৃতি বৈষম্য ও ভাগাভাগির ভাগ্য নিয়েই ছিল।
কবি নজরুল বিয়ে করে বিতর্কিত হয়েছিলেন। ছেলেদের নাম রেখেও তাই। কালীর বন্দনা করে শ্যামা সঙ্গীত লিখেও কালী কতটুকু খুশি হয়েছে জানি না তবে কালী দাসদের মন পেয়েছে বলে মনে হয় না। পক্ষান্তরে বিশ্বাসের আপন ভূমিতেও নজরুল শান্তির নীড়ে ছিলেন না। অল্প শিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত মোল্লা মৌলবিরা সত্যিই ছিল বিপদজনক। তারা কাফের ফতোয়া জারি করে দিয়েছিল যা ছিল একজন সাধক কবির জন্য কষ্টকর।
নজরুল ছিলেন ভালো মানুষ ও সৎ কবি।কবির সততা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রকৃতির কোলে লেটোর দল,মক্তবে পবিত্র কোরআন শিক্ষা, শৈশবে মসজিদে গমনাগমন তার অবচেতন মনে ইসলামি ঐতিহ্য সুদৃঢ় ভাবে গেঁথে ছিল। এজন্য মাঝখানে তার সুপ্ত ও ঘুমন্ত বিশ্বাসে একটু পাগলা হাওয়া বা বাউলিয়ানা লাগলেও ‘সব পাখি ঘরে ফেরে’র মতো তিনিও আমি পথ পেয়েছি বলে জাতির
কাঙ্ক্ষিত জায়গায় ফিরে এসেছিলেন। স্ত্রী-সন্তানের প্রতি স্বাভাবিক ভালোবাসায় সবাইকে বিশ্বাস করা ছিল কবির এক ধরনের দুর্বলতা।তাই কালীভক্ত বারীন্দ্র-এর শিষ্যত্ব তার জীবনের কালো অধ্যায়। অস্বাভাবিক বিশ্বাসের কাছে জল চাওয়া, রোগমুক্তি কামনা করা বাতুলতা ছাড়া কিছু নয়। অর্থ ও বিশ্বাসের সংকটে মানুষ দিশেহারা হয়।এ কারণেই কবি নজরুল অত্যন্ত জীবনীশক্তির অধিকারি হয়েও মস্তিষ্কের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। তিনি দীর্ঘ ৩৪ বছর (১৯৭৬-১৯৪২) নীরব হয়ে ছিলেন। আল্লাহ সুস্থ রাখলে বাংলা সাহিত্য আরও অনেক সমৃদ্ধি হতো।কেবল ২০/২১ বছরের সৃষ্টি আমরা পেয়েছি।কব নজরুল ইসলামের এই পরিণাম ও পরিণতি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ট্রাজেডি।আর মুসলিম বাঙালির জন্য নির্মম নক্ষত্র পতন।
কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন জনসংস্কৃতির প্রাণপুরুষ। বাঙালির আনন্দ-উৎসব, সংগ্ৰাম-মুক্তি,রমজান-ঈদ, ত্যাগ-তিতিক্ষায় নজরুল ইসলাম এক অনিবার্য ব্যক্তিত্বের নাম। তবে তার শ্যামাসংগীত পূজা পার্বণ, রকমারি নামযজ্ঞে
তেমন গাওয়া হয় বলে মাইকিং কানে আসে না।
দাদভাইয়েরা,
সালাম ও নমস্কার। আমাদের কালীপূজায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শ্যামাসংগীত পরিবেশন করা হবে। আপনারা সবান্ধব আমন্ত্রিত।
এমন এ্যানাউন্স বাংলাদেশে কেউ কোনদিন শুনেছেন? কিংবা পশ্চিমবঙ্গে?! আমি খোকসা ঐতিহাসিক কালীপুজায় এমন প্রচার শুনি নাই। তবে শুনলে ভালো লাগতো। এই পূজার সাথে আমার সাবেক ও বর্তমান সহকর্মিগণ নিবিড়ভাবে জড়িত থাকায় ওখানে যায়,খায়,বেড়ায়। কিন্তু সেখানে নজরুল চর্চা চোখে পড়ে না।
তাই নজরুল কেবল বাঙালি মুসলমানের একান্ত সম্পদে পরিণত হতে চলেছে। শেষ জীবনে ঠিক নয়, লেখার শেষ দিকে নজরুল ইসলামি দর্শনের একান্ত মুরিদ বনে গিয়েছিলেন।তার চার হাজারের অধিক গান,অর অসংখ্য কবিতায় এর প্রমাণ সোনার হরফে লেখা রয়েছে। লোকসংস্কৃতির যে ‘লোক’ তা মুসলমান বৈ অন্য কেউ নয়।
হয়তো বলবেন, কবিকে খন্ডিত করা হলো।আমি তা স্বীকার করি।কারণ আমি আমার এমন আপনজনকে সবার করে তুলতে আর বিতর্কিত করতে চাই না। মেরে ফেলতে চাই না। হারাতে চাই না। কবি নজরুল ইসলাম মুসলিম তবে তামাম টুকুই অসম্প্রদায়িক।এ দেশে এর চেয়েও বিখ্যাত কবিও এত ফুটফুটে সুন্দর বৈষম্যহীন নয়। তাদের লেখনিতে —
হিন্দু না ওরা মুসলিম! ঐ জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
এমন সাহসি উচ্চারণ বাংলা সাহিত্যে কয়জন করেছে?
ইংরজদের জুলুমের প্রতিবাদে—
এদেশ ছাড়বি কিনা বল,
নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল।
কোন চামচার পক্ষে এমন বলিষ্ঠ উচ্চারণ অসম্ভব।
কাজী নজরুল বিশ্ব মুসলিমের চেতনার বাতিঘর। কবি ফররুখ আহমদের আগেই তিনি মুসলিম উম্মাহর পূনজাগরণের পাঞ্জেরির ভূমিকা পালন করেন। ইসলামের সুমহান আদর্শের পুনরায় ক্ষমতায় দেখতে তিনি ছিলেন ‘অগ্ৰপথিক সেনাদল।’এজন্যেই তার অস্থিমজ্জার সচেতন চিৎকার —
‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা শির উঁচু করি মুসলমান,
দাওয়াত এসেছে নয়া জামানার ভাঙা কেল্লায় উড়ে নিশান।’
সংখ্যা গরিষ্ট মানুষের বিশ্বাসে চেতনার ঝড় তুলে নজরুল জনসংস্কৃতির প্রধান ও প্রথম প্রতিভূ। তাঁর কাব্যই আমাদের পথ ও পাথেয়। কাজী নজরুল ইসলামেই বাঙালির নিরাপদ আশ্রয়।কারণ শ্যামাসংগীত থেকে ইসলামি সংগীত সবই বাংলার। বাঙালির। আমাদের সবার।নির্মোহ গবেষণায় নজরুল অবিভক্ত। নজরুলকে যারা গ্ৰহণে ইতস্তত করে এটা তাদের ব্যর্থতা। নজরুলের নয়।