বরনীয় মানুষের বিস্মৃত কথা
-মো: আসলাম হোসেন
আজ থেকে প্রায় একশত পঁচিশ বছর আগের কথা। তখন পুরো ভারতবর্ষ মিলে এক দেশ। দেশ না বলে পুরোটাই একটা গ্রাম বলা যায়। এখনকার মত তখনকার জীবনযাপন চলাফেরা এত সহজ ছিল না। যাতায়াতের জন্য এত গাড়ি ঘোড়া ছিলো না। যাতায়াতের জন্য একমাত্র অবলম্বন ছিল বাষ্প চালিত রেলগাড়ি তাওতো সহজলভ্য ছিল না আর বর্ষাকালে যাতায়াতের অবলম্বন ছিল নৌকা। মানুষের জীবন যাপন ছিল খুবই সাদামাটা এবং কঠিন ।দুবেলা পেটপুরে খেতে পারাটা ছিল নিছকই ভাগ্যের ব্যাপার।সবার পড়নে অনেক কষ্টে জুটত তাঁতে বুনানো হাঁটু পর্যন্ত লন্বিত আধখানা ধুতি। স্হানিয় ভাষায় যাকে ‘কটকে ধুতি’ বলা হত।
এ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা এজন্যই জরুরী যে , তা নাহলে নজরুল কেন বিদ্রহী নজরুল হলেন তা বোঝা যবে না। নজরুলের জন্মের প্রায় দেড়শ বছর পূর্বে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকায় এবং তাদের ক্ষমতার মোহ বাংলার ভাগ্যকাশে যে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে নিয়ে এসেছিল তা হয়তো মীরজাফর এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা তখন কল্পনাও করেনি। সকল যুগেই ক্ষমতালোভী মীরজাফরেরা সামান্য ব্যক্তিস্বার্থে দেশের স্বর্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দেয়।স্বল্প সময়ের মধ্যেই মীরজাফরদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যায় ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাতে। বেনিয়াদের ব্যবসায়ের মানদন্ড রাজদন্ডে রূপান্তরিত হওয়ার সাথে সাথে বাংলায় নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। ছিয়াত্তরের ভয়াবহ মন্বন্তর ,ক্লাইভের দ্বৈত শাসন, জমিদার শ্রেণীর শোষন ও নির্যাতন, জোরপূর্বক নামমাত্র মূল্যে নীলচাষ ,দেশীয় শিল্প ধ্বংস ব্যবসা-বাণিজ্য ব্রিটিশদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ দেশের মানুষ সর্বশান্ত নিঃস্ব হয়ে যায়। পলাশী উত্তর যে বাংলা ছিল তৎকালীন বিশ্বের পাঁচটি শীর্ষ ধনী দেশের একটি,মাত্র কয়েক দশকে তা ভিখারিতে পরিনত হয়।ইংরেজদের তোষামোদকারী কিছু ব্যবসায়ী এবং জমিদার ও মহাজন শ্রেণী বাদেগোটা ভারতবর্ষের চিত্র ছিল এমনই।
সবুজ শ্যামল বাংলার শেষ প্রান্তে বিহার ও উড়িষ্যার কাছাকাছি রূঢ় প্রকৃতির আবহাওয়ার এক অখ্যাত গ্রাম চুরুলিয়া। ১৮৯৯ সালের ২৪ মে ১৩০৬ বঙ্গাব্দ ১১ই জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার কাজী আমিনুল্লার পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। শিশুর নাম রাখা হলো কাজী নজরুল ইসলাম এই শিশু জন্মের পূর্বে ফকির আহমদ দম্পতির আরো চারটি ছেলে জন্মের পরে মারা যায় অনেক দুঃখের পর তাকে পেয়ে বাবা মা ডাকত ‘দুখু’ বলে। সেই থেকেই সে হয়ে গেল দুখু মিয়া। তবে গ্রামটি একদম অখ্যাত বললে ভুল হবে। কারণ কোন এক সময় এখানে রাজধানী ছিল এখনো সেখানে রাজা নরোত্তমের গড় বিদ্যমান আছে।আছে মুসলিম শাসনামলের চুরুলিয়া গড়। মুসলিম শাসনামলে বিহারের রাজধানী পাটনার হাজীপুর থেকে একটি পরিবার চুরুলিয়াতে আসেন দিল্লীর সম্রাট শাহ আলমের সময়। যিনি সাম্রাটের পক্ষে স্থানীয় বিচার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন। তখনকার দিনে এই পদবীকে বলা হতো কাজী। সময়ের পরিক্রমায় সে সবকিছু আর নেই তবে পারিবারিক পদবীটা ঠিকই আছে।
তবে চুরুলিয়া গ্রামকে নিরেট মূর্খদের গ্রাম বললে ভুল হবে।গ্ৰামের প্রায় সবাই কৃষিনির্ভর হলেও তারা ছিলেন ভদ্র ও রুচিশীল। গ্রামে হিন্দু আর মুসলমান প্রায় সমান সমান। যুগ যুগ ধরে তারা মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। গ্রামের পশ্চিম পাশটায় হিন্দুদের বাস পূর্ব দিকে মুসলিমদের বসবাস। এখানে দীঘির পাশে ইসলাম প্রচারক দরবেশ হাজী মাস্তানের মাজার ও মসজিদ ।কাজী পরিবার এই মসজিদ ও মাজারের দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করে থাকে। গ্রামে কোন স্কুল নাই বটে তবে মক্তব আছে। আছে দুই তিনটা লোটো গানের দল। চাচা কাজী বজলে করিমেরই আছে একটি লোটোর দল। তিনি শিক্ষিত মানুষ । উর্দু ও ফার্শীতে তার ভালো দক্ষতা। তিনি কবি ও তার দলের জন্য নিজেই বাংলাতে ই কবিতা লেখেন। মাত্র ৮ বছর বয়সে দুখু মিয়া পিতৃহারা হন।
মসজিদ ও মাজারের থেকে পাওয়া যৎসামান্য আয় দিয়ে বিশাল পরিবারের ভারণপোষন খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। মক্তবের পড়াশোনা এবং মসজিদ ও মাজারের খাদেমগিরি দুখু মিয়ার বেশি দিন আর করা হলো না।সেই সময়টাতে স্কুল-কলেজ এত ছিল না। তবে গ্রামে গ্রামে লোটো গান, পালা গান ,কবি গান ,জারি গান, পুথি পাঠ এগুলোর ব্যাপক প্রচলন ছিল। দুখু মিয়া যোগ দিলেন চাচা বজলে করিমের দলে। চাচা তার ভাতিজার প্রতিভা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ।তাই সেই ছোট অবস্থাতেই তার মাঝে সুন্দর সুন্দর স্বপ্নের বীজ বপন করতে শুরু করেছিলেন । নিজে কবিতা লেখার পাশাপাশি ভাতিজাকে দিয়ে দলের জন্য কবিতা লেখাতেন। উর্দু ও ফার্সির ওপর দক্ষতা বাড়ানোর নিরন্তর চেষ্টা করে গেছেন। তবে এ কথা ভালো করে মনে রাখতে হবে দুখু মিয়াদের শৈশব ও কৈশোরের কোন ইতিহাস লেখা থাকেনা । গাঁও গ্রামের আর পাঁচটি শিশুর মতই অখ্যাত অবস্থায় বড় হয়ে বেড়ে ওঠে এবং আপন কর্মে তাঁরা বিখ্যাত হয়ে যান।দুখু নিজেও তার শৈশব এবং কৈশর নিয়ে কিছুই কখনো লেখেননি। লিখেছেন তার স্কুল জীবনের প্রাণপ্রিয় বন্ধু এবং গত শতাব্দীর মধ্যভাগের প্রখ্যাত কথা শিল্পী ও অভিনেতা শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। নজরুলকে নিয়ে তিনি দুইটি বই লিখেছেন” আমার বন্ধু নজরুল” এবং “কেউ ভোলে না কেউ ভোলে”।
বই দুইটি খুবই চমৎকার এবং তথ্যবহুল ।নজরুলের জীবনের অজানা অসংখ্য তথ্য সেখানে উপস্থাপিত হয়েছে। বড় ভাই কাজী সাহেবজান এর কয়লা খনিতে কাজ করে উপার্জিত আয় এবং লোটোর দল থেকে দুখু মিয়ার আয় মিলে ভালই চলছিল তাদের সংসার।ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে কেউটের ( দুখুর) সুনাম। ওই অঞ্চলে তখন ছিল শেখ চকোর ( গোদা কবি ) নামে একজন বিখ্যাত কবিয়াল। নজরুলকে তিনি আদর করে বলতেন ‘ব্যঙাচি’।তিনি শিষ্যদের বলতেন এই ব্যাঙাচিই বড় হয়ে একদিন সাপ হবে।