আমাদের স্বপ্নের কবি কাজী নজরুল ইসলাম
সাহেদ বিপ্লব
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে কিছু লেখতে গেলেই বার বার থমকে যেতে হয়, কেন না কাজী নজরুল ইসলাম কোনো সাধারণ কবি না, এতো কম সময়ে এতো বেশি লেখা পৃথিবীর কোনো কবি লেখে যেতে পারেনি।
আত্মাবিশ্বাসী এই কবিকে আমরা ভুলতে পারিনি। আমাদের বার বার ফিরে যেতে হয় তার সৃষ্টির কাছে, তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন পরাধীন থেকে মুক্তির, এই ভাতরবর্ষে যখন বৃটিশ গোলামীতে জিঞ্জিরে বাঁধা, তখন কবি বিদ্রোহী করে জেলে গেছেন, কেন তিনি বিদ্রোহী করেছেন তার পুরো ব্যাখ্যা তিনি রাজবন্দি জবাবন্দিতে দিয়েছেন, তিনি বলেছেন আমরা ভারববর্ষের লোক, এই দেশ আমাদের, তাহলে কেন আমরা ব্রিটিশের শাসনে থাকবো ?
তিনি মাত্র ২২ বছর বয়সে লিখেছিলেন ধুমকেতুর মত বিখ্যাত কবিতাটি, এই কবিতায় উপমহাদেশের স্বাধীনতার দাবি তুলে ধরেছিলেন, তিনি আমাদের মুক্তি চেয়েছিলেন, স্বাধীনতার মুক্তি।
সৃষ্টির আলোয় একই সঙ্গে মানবতা ও প্রেমকে ধারণ করেছিলেন তিনি, কবিতা কিংবা গানে ছড়িয়েছেন সাম্যের বাণী, অন্যায় কিংবা শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্ছার হয়েছেন, তার কলম মানবতায় দীক্ষিত হয়ে মানেনি জাত-পাত বা ধর্মের সীমারেখা।
ব্রিটিশ শাসনামলে বিদ্রোহী কবিতাটি লেখে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তার গান থেকে, এভাবেই বিদ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও বিদ্রোহের কবি হিসেবে ঠাঁই করে নেন বাংলা সাহিত্য ও শিল্পানুরাগীদের মনে।
সংকট কিংবা দুঃসময়ে আজও তিনি বাঙালীর অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি গনমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে জীবন ধরে সংগ্রাম করে গেছেন, এমনকি বাংলা সাহিত্য ও শিল্পের নতুন পথের দিশারী এই কবি।
আল মাহমুদ বলেছেন, হাজার বছর পরে এক জন কবির জন্ম হয় কিন্ত কাজী নজরুলের মত কবি পৃথিবীতে আর জন্ম হবে না, শুধু হাজার বছর নয় কোটি বছর পরেও না।
আমরা যারা দুই চার কলম লেখি, যখন কাজী নজরুলের সাহিত্যের দিকে চোখ মেলে তাকাই, তখন মনে হয় আর কিছু লেখার দরকার নেই, আমরা যা কিছু ভাবতে চাই, কাজী নজরুল ইসলাম অনেক আগেই তা ভেবে লেখে গেছেন।
ভোর হলো দোর খোলো
খুকমনি ওঠরে
ঐ ডাকে জুঁই শাখে
ফুল খুকী ছোট রে।
কি অসাধারণ মিল ছন্দের, আমাদের শিশুরা মাথা দুলে দুলে মনের আনন্দে এই ছড়াটি পড়ে, ইসলামি গানেও তার জুরি নেই,
এই সুন্দর ফুল,
সুন্দর ফল,
মিঠা নদীর পানি
খোদা তোমার মেহের বাণী।
শস্য শ্যামল ফসল ভরা
মাটির ডালি খানি
খোদা তোমার মেহেরবাণী।
এমনকি “ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ” আমাদের বাঙালী মুসলমানদের এই গানটি ছাড়া ঈদ হয় না বললেই চলে, কাজী নজরুল ইসলামের প্রায় সব লেখা জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
তার বিদ্রোহী কবিতাটি এতো শব্দ, এতো বক্তব্য পৃথিবীর আর একটা কবিতায়ও নেই, এমনকি পৃথিবীতে এই ধরনের কোন কবিতা কেউ সৃষ্টি করতে পারেনি এবং পাবরে না।
নোবেল কমিটি তার এই বিদ্রোহী কবিতার জন্য নোবেল পুরস্কার দিতে পারতো কিন্ত কেন দেইনি তা আমাদের বোধগম্য নয়, আমরা নোবেল ইতিহাসে দেখেছি কাজী নজরুল ইসলামের চেয়ে অনেক কম প্রতিভার লেখকগন নোবেল পেয়েছেন।
কাজী নজরুল ইসলামকে কেন দেয়া হলো না এমন একটা প্রশ্ন রেখে গেলাম আমি।
বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা গেছে অনেক কবি নোবেল প্রত্যাখ্যান করেছেন কিন্ত কাজী নজরুল ইসলামকে নোবেল পুরস্কার দিলে প্রত্যাখ্যান করতো কি না কে জানে? অনেক নজরুল গবেষকরা মনে করেন কাজী নজরুল ইসলামকে নোবেল দিলে তিনি নিতেন কিনা তা নিয়ে অনেক সন্দেহ আছে, কেনো না নজরুল বলেছেন, আমি পৃথিবীতে এসেছি প্রেম দিতে, প্রেম নিতে, কবি হতে আসেনি, নেতা হতে আসিনি, টাকা এমনকি অর্থের দিকে তার কোন লোভ ছিলো না।
রণ সঙ্গীতে কবি বলেছেন
চল্ চল্ চল্
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণী তল
অরুণ প্রাতের তরুল দল
চল্রে চল্রে চল।
অনেকেই মনে করেন জাতীয় সংগীত নজরুলের লেখা গান থেকে করা যেতে পারতো, কেন না, এই কবির অনেক গান আছে যা জাতীয় সংগীত করার মত, আমি সেই বির্তকে যেতে চাই না।
নজরুল আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন স্বাধীনতার স্বপ্ন, বেঁচে থাকার স্বপ্ন, এমনকি মুক্তির স্বপ্ন, বলা যায় নজরুল স্বপ্ন দোষ্টা।
নজরুলকে আমরা কোন ভাবেই ছোট করে দেখার প্রয়োজন বোধ মনে করি না, ২৩ বছরের সাহিত্য র্চ্চা আমাদের বাংলা সাহিত্যকে একটা যুগের সুচনা করে দিয়েছে, এমন কোন শাখা নেই যেখানে নজরুলের হাত পরেনি এবং যেখানেই হাত পরেছে সেখানেই শুধু আলো নয়, কালজয়ী লেখা সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের দেশের মানুষের জন্য। নজরুল আমাদের কাছে চিরকাল বেঁচে থাকবে তার সৃষ্টি এবং সাহিত্যে।
আমরা যারা লেখালেখি করি, তাদের সবার ব্যক্তিগত লাইব্রেরী আছে, সেখানে গাদা গাদা বই রয়েছে, আমরা সেই সব বই পড়ে লেখার ধারনা নিয়ে থাকি, ঢাকার অনেক নাম করা লেখকদের বলতে শুনেছি, একটা কবিতা লেখতে হলে, কম হলোই একশটি কবিতা পড়তে হবে, আগে পড়া তারপর লেখা কিন্ত নজরুলের ব্যক্তিগত কোনো লাইব্রেরী ছিলো না।
তাহলে কি ভাবে সাহিত্য চর্চা করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম এটাই ভাবার বিষয়, পথে ঘাটে যেখানে নজরুল গিয়েছেন সেখানেই কবিতা লেখেছেন, কেউ যদি বলেছেন, কবি একটা কবিতা লেখেন তো, নজরুল সাথে সাথে একটি কবিতা লেখে তার হাতে দিয়েছেন।
আমরা দেখেছি “খেয়া পারের তরণী” কবিতার ইতিহাসে ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য, নবাবজাদী মেহেরবানু একটা ছবি আকেঁন, সেই ছবি দেখে নজরুল এই কবিতাটি লেখেন, “রাজবন্দির জবানবন্দি” বিচারপতির কাছে নজরুল যে কথা গুলো বলেছিলো, সেইকথা গুলো আজ বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী ইতিহাস।
নজরুল কখনো অর্থের দিকে তাকায়নি, তিনি চেয়েছেন এই দেশের মানুষের মুক্তি, প্রথম জীবনে সেনাবাহিনীতে চাকরি পেয়েছিলেন এবং তিরিশ মাস চাকরি করেছেন, আজ অনেক নজরুল গবেষক অবাক হয়ে বলেন, নজরুল কি ভাবে এই সৈনিক জীবনে থাকতে পারলো, যে মানুষটি এতো চঞ্চল, প্রতিবাদের ঝড়, সেই মানুষ সেনাবাহিনীর চাকরি করে আমাদের বুঝিয়ে দেয়েছেন, অর্থের লোভ যদি তার থাকতো তাহলে তিনি জীবন ধরে চাকরি করে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন কিন্ত তিনি চেয়েছেন এই দেশের মানুষের মুক্তি।
সাহেদ বিপ্লব
প্রকাশক, টইটই প্রকাশন
৩৪ নর্থব্রুক হল রোড, মাদ্রাসা মার্কেট
বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০
মোবাইল : ০১৯৩৪-০৯১৫৭৭