সাহিত্য পত্রিকা তথা লিটল ম্যাগের গুরুত্ব অপরিসীম।তারা ভূমিকা রাখতে পারে সুসাহিত্যিক সৃজনে। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, দীর্ঘ দুই দশক ধরে সাহিত্যের এই বন্ধুর পথ হাটতে গিয়ে দেখলাম, শুনলাম এবং বুঝলাম-এই যে ম্যাগাজিন হচ্ছে তন্মধ্যে পরিপাটি, সুবিন্যস্ত এবং সফল ম্যাগাজিন বলতে খুব কম সংখ্যকই বাজারে এসেছে।যাওবা এসেছে তাদের অধিকাংশেরই মৃত্যু ঘটেছে অকালে।স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি বলেছিলেন, ‘এই দেশে শিশু মৃত্যুর হারের চেয়েও সাহিত্য ম্যাগাজিন মৃত্যুর হার অনেক বেশি।’
যথেষ্ট পরিপোষণের অভাবেই পুষ্টিহীনতায় ভুগতে থাকা ম্যাগাজিন আর কতোদিন একজন সম্পাদক টিকিয়ে রাখতে পারেন? এরপর শুরু হলো ফেসবুক, ওয়েবসাইট, ফেসবুকে গ্রুপভিত্তিক প্রতিযোগীতা, ই-পেপার ইত্যাদির যুগে এসে সাহিত্য নির্ভর ম্যাগাজিন নিয়ে বাজারে টিকে থাকা দুরুহ ব্যাপার।মরহুম মীজানুর রহমানের মতো স্ত্রীর গহনা বন্ধক রেখে ম্যাগাজিন সম্পাদনা করার মতো বুকে অসীম সাহস পোষা সম্পাদকই বা আর কজন আছে?
এই যে ফেসবুকের কাছে এসে দেখলাম, অনেক নতুন নতুন ম্যাগাজিন এলো বাজারে। লেখা আহবান করা হয়। লেখা পাঠালেই সম্পাদক সাহেব বলে বসলেন, ‘টাকা পাঠান’। এক/দুইজন নয় । প্রায় অধিকাংশরাই চেয়েছেন টাকা। আর আমিও প্রতীজ্ঞা করে বসে আছি- আর যাই হোক ‘পয়সা দিয়ে কোন লেখা প্রকাশ করবো না। কোন দিনও করবো না। প্রয়োজন হলে-সামর্থ থাকলে, আর্থিক সহযোগীতা করবো।তবুও লেখা ছাপানোর বিনিময়ে টাকা পাঠাবো না।’ এমনকি সামর্থ না থাকলে গড়ে সকল লেখকের কাছে হাত পেতে ম্যাগাজিন সম্পাদনার মতো কর্মটিও আমি করবো না।ইতিপূর্বে যা করা হয়েছে, তাতো হয়েছেই।
সেদিক থেকে অহনা একটি ব্যাতিক্রমী উদ্যোগ মনে হয়েছে। এটি একটি শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ম্যাগাজিন।ফেব্রুয়ারীতেই এর ২য় বর্ষের ১ম সংখ্যাটি হাতে পেয়েছি। প্রচ্ছদটা দেখে খুব ভালো লেগেছে।প্রচ্ছদ পরিচিতি লিখেছেন কবি সোলায়মান আহসান। একশ বিশ পৃষ্ঠায় উন্নত মানের কাগজে সমৃদ্ধ একটি পত্রিকা। সম্পাদনা করেছেন- শক্তিমান কবি রহমান মাজিদ। শুরুতেই সম্পাদক সাহেব স্বউদ্যোগী হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গালা ভাষা’ শিরোনামের একটি লেখা পূণ:মুদ্রণ করেছেন। তারপরে প্রবাসী কবি কাজী জহরিুল ইসলামের ফরমায়েশী একটি প্রবন্ধ ‘বাংলা কবিতা-পঞ্চাশের ত্রিভূজ’ ছেপেছেন। শামসুর রাহমান , আল মাহমুদ এবং শক্তিচট্রপাধ্যায়ের তুলনামুলক একটি বিশ্লেষনে তুলোধুনা করা হয়েছে। যা পাঠে আমার তৃষিত অন্তর প্রশান্ত হয়েছে।
এরপর কবি শম্ভু রক্ষিতের জীবন ও সাহিত্য’র বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন প্রিয় কবির জন্য অক্ষরমালা শিরোনামের একটি লেখায়- হরিৎবন্দ্যোপাধ্যায়।২৯ পৃষ্ঠা থেকে ৩২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত অজয় দাস তালুকদারের লেখা প্রবন্ধ- নাট্যচর্চার অতীত গৌরব ও অস্তিত্ব সংকট’ শিরোনামের লেখাটি প্রভূত গুরুত্ব বহন করে।
বাংলাদেশের কবিতা অংশে ৩৩ খেতে ৪৯ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখেছেন- কবি আব্দুল হাই শিকদার, রেজাউদ্দিন স্টালিন, নিজাম উদ্দিন সালেহ, মুকুল চৌধুরী, মুস্তফা হাবীব, অনিরুদ্ধ আলম, তাজ ইসলাম, সিদ্দিক আবু বকর, দিলরুবা নীলা, পলিয়ার ওয়াহিদ, সুজন আরিফ, দালান জাহান, এরশাদ জাহান, ইকবাল পারভেজ, সোহেল মাহবুব, জহির সাদাত, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সাহেদ বিপ্লব, রাবাত রেজা নূর, খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইন, কুমকুম দত্ত, হামিদুল ইসলাম।৫০ থেকে ৫২ তম পৃষ্ঠায় গুচ্ছ কবিতা শিরোনামে কবি হাসান আলীমের তিনিটি কবিতা মুদ্রিত হয়েছে।
৫৩ পৃষ্ঠা থেকে ৫৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পশ্চিম বঙ্গের কবিতা অংশে লিখেছেন- দেবাশিস সাহা, মনোতোষ আচার্য, ইন্দ্রাণী পাল, কৌশিক চক্রবর্ত্তী, প্রিয়া কুন্ডু নন্দী, প্রদীপ মন্ডল, রোহীনি কান্তু রায়, সুকমল ঘোষ, নীল গৌরব মামুন প্রমুখ।
৫৯ পৃষ্ঠা থেকে ৬০ পৃষ্ঠায় রয়েছে সায়ীদ আবু বকর অনূদিত তিনটি বিদেশী কবিতা।
৬১ পৃষ্ঠা থেকে ৬৪ পৃষ্ঠায় রয়েছে ওয়াজেদ বাঙালি,পান্না বদরুল, কবির কাঞ্চন, রোমানুর রোমান ও সোহেল আহসানের ছড়া।
৬৫ পৃষ্ঠা থেকে ৯৯ পৃষ্ঠা পর্যন্ত দেশি বিদেশী মোট চারটি গল্প মুদ্রিত হয়েছে। গল্প লিখেছেন ড. মোহিত কামাল,লুনা রাহনুমা, উম্মুল খায়ের ও ফরাসী গল্পকার মোহাম্মদ মীর কিয়ানীর গল্প অনুবাদ করেছেন শাকির সবুর। শততম পৃষ্ঠায় আমিন আল আসাদের হবিগঞ্জ ভ্রমণের নানা অভিজ্ঞতার গল্প নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দাঁড়কাকের সমালোচনা পর্ব শেষ করে গ্রন্থালোচনা করা হয়েছে। সেখানে ফররুখ আহমেদের শ্রেষ্ঠ শিশু-কিশোর সাহিত্য কবি হাসান আলীমের ফানা ফিল্লাহর কথা এবং আহমেদ আল আমীনের ঝোপঝাড়ে তারা জ্বলে মুদ্রিত হয়েছে।
ভূমিকায় সম্পাদক তার সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে পাঠক কূলের নিকট একটি প্রশ্ন ছূঁড়ে দিয়েছেন-‘ সাহিত্য ভোগ্য পণ্য কি?’
পরে তার যথোপোযুক্ত জবাবও দিয়েছেন। আমি একজন স্থুল বুদ্ধি জ্ঞানের মানুষ হিসাবে এতো টুকুই বুঝতে সক্ষম হলাম যে, সম্পাদক সাহেবের সময় জ্ঞান আছে।সময় সচেতনতা ছাড়া উপযোগী সাহিত্য কীভাবে সৃষ্টি হবে।