ডা.খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইন: সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বাদ দিয়ে তাবিজ, মুনাজাত, মিলাদ, কিয়ামের মতো জনগুরুত্বহীন সমস্যা নিয়ে বিরোধকে সামনে আনার অর্থ কী???
হ্যাঁ, বক্তার কথা-বার্তা রুচিশীল হওয়া উচিৎ। উচিৎ মনে করি সহনশীল ও যুক্তি ভিত্তিক, সময়োপযোগী আলোচনা করুক বক্তারা। এই আলোচনার দ্বারা হিংসাত্মক পরিস্থিতি আরো উস্কে না দিয়ে হেটার্স এবং লাভারদের মধ্যে সহবস্থানের পরিবেশ যেনো বিঘ্নিত না ঘটে সে দিকে লক্ষ্য রাখাও একজন সু বক্তার উচিৎ দায়িত্ব বলে মনে করি।
বক্তা ইসলামি দায়ী হলেতো আরো কৌশলী হওয়া তার শুধু উচিতই নয় বরং তাকে সামাজিক দায় নিয়েই কথা বলা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
বক্তা হওয়ার আগে ধর্মীয় জ্ঞানের বাইরেও তাকে সার্বিক বিষয়ে মোটামুটি জ্ঞান লাভ করা কর্তব্য।
বালাগাত মানতেকের জ্ঞান যদি ন্যূনতমও না থাকে তাহলে তাকে বক্তৃতার মঞ্চে উঠাই মনে করি ঠিক নয়, বরং পাপ।
পরিবেশের চাহিদা আর শ্রোতার চাহিদা এক নয়। শ্রোতার মানসিক অবস্থা আর পরিবেশের মানসিক অবস্থাও এক রকম নয়। ফলে, বক্তার জানা উচিৎ যে, বিশুদ্ধ বক্তব্য দিতে হলে পরিবেশের চাহিদা এনং শ্রোতার মানসিক অবস্থা সর্বাগ্রে বিবেচনা করা।
আবার পরিবেশ চাইলেই শ্রোতার উপর মানসিক অবস্থা না বুঝে চাপিয়ে দেবেন আপনার মতামত সেটাও ঠিক হবে না।
একটা গল্প করা যাক, আজ সকালে বাসা থেকে বের হচ্ছি। বাসাটা আবার কী? গ্রামের বাড়ি থেকে বের হচ্ছি। পথে ভ্যান-ট্যান কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছি। পিছে পিছে আমার ছেলে জিয়াদ আল সাবিত, ছোট ভাইয়ের দুই বছরের মেয়ে রূফাইদাহ বহ্নি এসে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ একজন ভ্যান নিয়ে এলেন, তাকে চিনি গ্রামেরই লোক তিনি। ছোট ভাইয়ের টুইয়ার্সের বেবিটার গলায় তাবিজ দেখেই চিৎকার করে উঠলেন। “তাবীজ?? ” গলায় তাবিজ কেনো??
শিরক করলে কেনো? কাফের হয়ে গেছো, মুশরিক হয়ে গেছো ইত্যাদি।
কোন কথা না বলেই ভ্যানে চেপে বসলাম। লোকটি আবারো কথা গুলো বললো। ভ্যান চলছে, মোটর চালিত ভ্যান। কোন কষ্ট ও ঝামেলাহীন চলে। ফলে ভ্যান চালকের মুখও খুব দ্রুত চলে। অবাক হলাম লোকটির বয়ানের ধারা শুনে। বুঝলাম তিনি আহলে হাদীস মওলানাদের বয়ান শোনে। যতদূর জানি, লোকটি লেখা পড়া না জানা গ্রামের মানুষ ছিলো। আহলে হাদীসের অনুসারী হয়ে এমন পাল্টে গেলো? বিরক্ত লাগছিলো। একাধিকবার বলার পর বললাম, এসব বয়ান আহলে হাদীসের অনুসারীদের কাছে বলা উচিত ছিলো আপনার।
তেড়িয়া হয়ে বলে উঠলো, হুহ্, শিরকের বিরুদ্ধে না বললে ঈমানই তো থাকে না৷ বললাম, আমার ঈমান গেলে তোমার কীই বা গেলো?
বললো, শিরকের বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে। বললাম সঠিক।
তা তাবীজ শিরক কেনো?
বললো- তাবীজের মাধ্যমে শেফা কামনা করাইতো শিরক!
ওহ্ আচ্ছা- ভ্যান চালানোর মাধ্যমে রিজিক চাওয়া শিরক হয় না?
বললো, না।
তুমিতো মিথ্যাবাদী, ভোট চোর, বদমায়েশ, বেপর্দার বিরুদ্ধে বয়ান করতে পারো। তাবীজ সমাজের এতো কিইবা ক্ষতি করলো? সে বললো, তাবীজের বিরুদ্ধেই আমাদের প্রধান সংগ্রাম। আমি বললাম, ভাই আপনি আমাকে নামিয়ে দিন। আপনার ভ্যানে আমি যেতে রাজি নই। লোকটি থমকে গেলো।বললাম, হুঁ। নামিয়ে দিন। নামতেই আরেকটি ভ্যান এলো, এবং আমাকে নিয়ে বিলজানি বাজারে পৌঁছে দিলো। আলহামদুলিল্লাহ। সেখানে নামতেই একটি সুপার ডিলাক্স বাস থামিয়ে হেলপার বললো, ঢাকা যাবেন?
ইয়েস। যাবো। উঠে পড়লাম। পুরো বাসে দশ বারোজন যাত্রী। পছন্দ মতো সীটে বসিয়ে দিলো এবং মাছপাড়া গিয়ে একটি টিকিটও নিশ্চিত হলো। আল্লাহর পূর্ণ রহমত নিয়েই ঢাকায় এসে চেম্বারে বসেছি।
এখন কথা হলো, আমি তাবিজ বিরোধী নই। আবার তার পক্ষেও নই। বিরক্ত হই। আহলে হাদীসের এই সব শ্রোতাদের জন্য মাঝে মাঝেই বিরক্ত হই। আজ থেকে দশ বছর আগে এই দলের আবির্ভাব হয় আমার পরিচিতদের মধ্য থেকে। এদের প্রথম কথাই হয় বেরসিক। বুঝাতে চায় ধর্ম যা বুঝার তারাই বুঝলো আর কেউ বোঝেনি। কঠোরতার সাথে বুঝাতে আসে নাকি ফরমায়েশ করে বুঝি না। তখন লোকটিকে বলেছিলাম, আপনারা ধর্ম প্রচার করুন, বাড়াবাড়ি করবেন না। এভাবে করলে ঝগড়াঝাটি হবে, মার্ডার পর্যন্তও হতে পারে। আমি ধারণা প্রসূত ভবিষ্যদ্বাণী বলার সাত বচ্ছরের মাথায় এদের দুই গ্রুপের মসজিদ দখলকে কেন্দ্র একটা মার্ডার হয়ে গেলো। কী সাংঘাতিক এবং মর্মান্তিক ঘটনা ঘটলো! পরিতাপ এখানে, যে ছেলেটি মারা গেলো সে কখনোই নামাজ-রোজা, মসজিদ, মুসল্লি নিয়ে ভাবতো না। ভাবার সময়ও ছিলো না। কারণ, সে একজন কাঠুরিয়া ছিলো। কাঠ কেটে আসবাব বানোই ছিলো তার পেশা ও সে অনেকটা অশিক্ষিত কাঠ মিস্ত্রি ছিলো।
এই কিছুদিন আগে প্রতিবেশী আরেকটি ছেলের ভ্যানে চড়ে খোকসায় যাচ্ছি। ছেলেটি রাগে গজগজ করছে।কী ব্যাপার? এমন করে কেনো?
বললো, পার্শ্ববর্তী বড় মওলানার নিকটে সে শুনেছে, সম্মিলিত মোনাজাত করা জায়েজ আছে। কোথাও নিষেধ নেই।
কিন্তু আহলে হাদীসের অনুসারীরা গ্রামে উঠে পড়ে লেগেছে সম্মিলিত মোনাজাত রুখে দিতে হবে।
এই নিয়ে কি আবারো ঝগড়া হবে গাঁয়ে। এসব নিরক্ষর মুসলিমদের মধ্যে সামান্য বিষয়কে বড় করে উপস্থাপন করে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেওয়ার দায় কে নেবে?
দায়টাতো ওই সকল বক্তাদেরই নিতে হবে যারা দলভারী করতে গিয়ে সমাজের মানুষদের মধ্যে হিংসা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
সামনে রমজান আসছে। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা যাচ্ছে না মোটেই। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা বিরাজিত। এমন একটা সময় এসে আবার আট রাকাত আর দশ রাকাআতের বিতর্ক বিরোধ নিয়ে সরব হতে পারে শয়তান। শয়তান এখন রমজানে আসে। শয়তানের শঠতার শক্তিও বৃদ্ধি পায়। সম্ভবতঃ রমজানের সেই শয়তান বাঁধার শিকল এখন আর কাজ করে না। অথবা হাদীসটি জাল-জয়িফ কিছু একটা ছিলো।
আল্লাহ মানুষকে মুক্তি দাও। গ্রামে শান্তি দাও। ইসলাম দাও। আহলে হাদীস বা হানাফি, মালেকি, হাম্বলি, কাদিয়ানি, হেজবুত তওহিদ, আহলে কুরআন দিও না।