।। আরফানুল জান্নাত ।।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য গণহত্যা-নির্যাতন। বাংলাদেশ গণহত্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের দ্বারা প্রায় ৩০ লক্ষ প্রাণ হারায়। সাধারণ বৈশিষ্ট্য এটি নির্বিচারে সংঘটিত হয়। সাধারণ বৈশিষ্ট্য মেনে একাত্তরে সংঘটিত বাংলাদেশ গণহত্যাও নির্বিচারে ,পরিকল্পনামাফিক সংঘটিত হয়েছে । গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দেয়া হয়েছে, আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে , লুট করা হয়েছে। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে এত ছোটো ভৌগোলিক সীমারেখায় ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা ইতিহাসে আর দেখা যায় না। এই গণহত্যার তীব্রতা ছাড়িয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সংঘটিত হলো কাজকে হলোকাস্টকে ।
মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা সংগঠনের পেছনে যে দর্শনগুলো কাজ করেছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো-পাকিস্তানি শাসকদের ক্ষমতার মোহ, বাঙালি ও পাকিস্তানীদের পরস্পর বিরোধী দর্শন, ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের প্রতি আক্রোশ থেকে গণহত্যা, নতুন জাতি সৃষ্টির আজগুবি ধারণা , বাঙালির ঐতিহ্য ও আকাঙ্ক্ষা সাথে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতির বিরোধ , পাকিস্তানের অখন্ডতা, ইসলাম রক্ষা, বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা, মেধাশূন্য জাতি সৃষ্টি, জাতিগত শুদ্ধিকরণ, সুপরিকল্পিত গণহত্যা, ইজ্জত বাঙালি হত্যার,শালী ব্যক্তিদের বাঙালি হত্যার নগ্ন প্রতিযোগিতা, দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখার জন্য ইচ্ছাকৃত ধ্বংস সাধন ও গণহত্যা প্রভৃতি। কিন্তু পাকিস্তানের সাথে তাদের এদেশীয় দোসররা ( রাজাকার, আল বদর, আলশামস,শান্তি বাহিনী ও অবাঙালি বিহারি সম্প্রদায়) মিলে ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত করেছিল। এমন একটি গণহত্যা ছিল ইটনা সদর থানার ওয়ারলেছস কেন্দ্র গণহত্যা। যেটি সংঘটিত হয়েছিল ইটনার মধ্য ও পূর্ব গ্রামে।
এটি সংগঠিত হয়েছিল ২৬ আগস্ট ১৯৭১ ইটনার সাপ্তাহিক বাজারের দিন। বিকেলে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল এসে বাজারে প্রবেশ করে। ইটনার রাজাকার প্রধান দেওয়ান আব্দুর রহিম তাদের স্বাগত জানায়। বাজারে ঢুকেই পাকিস্তানি সৈন্যরা বেপরোয়া লাঠিপেটা শুরু করে ।এখানে সাধু নামে একজনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। জমিদার আব্দুর রহিম সাহেব হানাদারদের ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে আরাম আয়েশের জন্য তার বিলাসবহুল বাসগৃহ ‘রঙ্গমহলে” নিয়ে যান। আর সৈনিকরা রক্তের নেশায় হায়েনার মতো হিন্দু বসতিগুলোর উপর চড়াও হয়। রহিম সাহেব তার লোকজনকে আগেই বলে রেখেছিলেন সেনাবাহিনী আসার সাথে সাথে তারা যেন বড় হাটির মসজিদে চলে যায়, আর মেয়েরা বাড়িতে বসে উচ্চস্বরে কোরআন শরীফ পড়তে থাকে।
তা’হলে মুসলমানরা তাদের হাত থেকে রক্ষা পাবে। সেই অনুযায়ী রহিম সাহেবের অনুগত লোকজন পাঞ্জাবি- টুপি পরিধান করে তসবীহ হাতে নিয়ে মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদের দেখাদেখি আরও বহু লোকজন বড় মসজিদে জড়ো হয়। দেখতে দেখতে সে স্থানটি লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে ।কিছুক্ষণ পর রহিম সাহেব ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলে একজন সুউচ্চ স্বরে আযান দিতে শুরু করে ।অথচ সেই সময় আজানের কোন ওয়াক্ত ছিল না ।ক্যাপ্টেন একসঙ্গে এত লোকজন দেখে জিজ্ঞাসা করেন,এরা কারা? এরা সবাই আমার নিজের লোক।
এরা ঈমানদার মুসলমান এবং খাঁটি পাকিস্তানি। বাংলাদেশের ‘বি’কেও তারা মনে প্রাণে ঘৃণা করে। অতঃপর তার ইশারায় সবাই নারায়ে তাকবীর ‘পাকিস্তান জীন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে শুরু করে । আব্দুর রহিম সাহেব সেদিন এই কৌশলের মাধ্যমে শুধু মুসলমানদের জান মাল রক্ষা করতে পেরেছিলেন, কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে পাকিস্তান বাহিনির আক্রমণের কোন পূর্বাভাস ছিল না এবং তাদের বাড়িতে কোরআন বা অন্য কিছু পড়ার ব্যবস্থা ছিল না ।
তাদের ঈমানদারী ও দেশপ্রেমের সাক্ষ্য দিতে তাদের পাশে সেদিন কেউ দাঁড়ায়নি।। উপরোক্ত নিজেদের রক্ষা করার জন্য মসজিদে আশ্রয় নেয়া টুপি পাঞ্জাবি পরিধান করা, কোরআন তেলাওয়াত করা এই আচরণগুলো একতরফাভাবে হিন্দুদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়ারই নামান্তর ছিল । পাকিস্তানি বাহিনী হিন্দু বসতিগুলো চিহ্নিত করে সহজেই তাদের উপর হামলা চালাতে পেরেছিল। বাজারে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে হানাদাররা পার্শ্ববর্তী ঋষিপাড়া, কামারপাড়া এবং কুমারপাড়ায় হামলা করে। এখান থেকে বহু নারী- পুরুষকে ধরে তারা পূর্ব গ্রাম ওয়ারলেস কেন্দ্রে নিয়ে যায় । পথ থেকে তারা হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে আরও অসংখ্য লোকজনকে বন্দী করে ।
যারা পালানোর চেষ্টা করেছিল, তাদেরকে বেদম লাঠিপেটা করে টেনে হিঁছড়ে নিয়ে যায়। ওয়ারলেস কেন্দ্রে নিয়ে এসে সবাইকে লাইন করে দাঁড় করানো হয়। তারপর শুরু করে বাছাই প্রক্রিয়া।যারা নিজেদেরকে মুসলমান এবং খাঁটি পাকিস্তানি হিসেবে পরিচয় দিতে পেরেছিলেন ,তারাই সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। কে হিন্দু , কে মুসলমান তা নিশ্চিত করতে বর্বর পাকিস্তানিরা লোকজনকে বিবস্ত্র করে খৎনা করা আছে কিনা তা যাচাই করে।রফু মিয়া নামে ১৩/১৪ বছরের এক কিশোরকেও লাইনে দাঁড় করানো হয়েছিল। সে একজন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় ছিল।
ঘটনাস্থল থেকে সামান্য দূরেই ছিল তার বাড়ি। বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য হঠাৎ সে দৌড় দেয়। সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে এক পাকিস্তানি বাহিনী লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে। বাইরের গ্রাম থেকে বাজার করতে আসা লোকজন ইটনায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আসার খবর জানতে পেরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল। জল পূর্ণ হাওরে ভাসমান নৌকা দেখতে পেয়ে হানাদাররা গুলি ছুড়তে শুরু করে। এতে অনেক নৌকা ডুবে যায় এবং অনেক লোকজন হতাহত হয়। অতঃপর বাকি লোকদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন ।এক পর্যায়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্রাশফায়ারে নারী-পুরুষ সকলের করুন আহাজারি সমাপ্তি ঘটে।
এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর সকল মৃতদেহ হাওরের জলে ফেলে আসা নির্দেশ দিলে কিছু লোকজন নৌকায় করে সকল মৃতদেহ গুলো নিয়ে যায়। তারা দেখতে পায় তখনও কিছু লোক জীবিত রয়েছে। মারাত্মকভাবে আহত হবার পরও ওরা অসীম ধৈর্য্য সহকারে মৃত্যুর ভান করে পড়ে থেকেছিল। নৌকার মাঝিরা তাদেরকে নিয়ে অন্য গ্রামে রেখে আসে এদের মধ্যে অনেকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে গেলেও সারা জীবনের জন্য তাদের পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। মধ্যগ্রাম ও পূর্ব গ্রাম ওয়ারলেস কেন্দ্রে নিহতদের মধ্যে যাদের পরিচয় জানা গেছে তারা হলেন-যোগেন্দ্র ঋষি, সুশিলা রানী দাস, প্রহ্লাদ চন্দ্র পাল, যাদব চন্দ্র সাহা রঘু মিয়া বাবুল চন্দ্র সাহা লক্ষীকান্ত সাহা, শয়ন লক্ষ্মী সাহা, মনোরঞ্জন পাল ,মিছির আলী, অক্ষয় কর্মকার ,মন দয়াল কর্মকার, ইন্দ্রজিৎ কর্মকার, কার্তিক পাল, ধরণী পাল, সাধু ও ওয়াজউদ্দিন। একাত্তরের গণহত্যা ছিল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে হত্যা ইংরেজিতে যা বলা যেতে পারে টার্গেট কিলিং। এই টার্গেট কিলিং কতটা পরিকল্পনা করে হয়েছিল সেটাই বিশ্লেষণ করেছিল আন্থনি ম্যাস কারেনহাস । তাকে এক সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের আমরা কেবল হিন্দুপুরুষদের হত্যা করেছি। হিন্দু নারী ও শিশুদেরকে ছেড়ে দিচ্ছি ।
সৈনিক নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করার মত কাপুরুষ আমরা নই।’ কিশোরগঞ্জ জেলা সহ সারা দেশের গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ সহ সকল ধরনের নির্যাতনের ঘটনা সংগঠনে পাকিস্তানিদের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল এদেশীয় কিছু দোসর। পৃথিবীতেই প্রতিটি গণহত্যার বিচার হয়েছে, বাংলাদেশেও চলছে ।কিশোরগঞ্জ জেলা’ সহ সারাদেশে যে সমস্ত গণহত্যা ও নারী নির্যাতনে এদেশীয় পাকিস্তানি দোসর সরাসরি জড়িত তাদের বিচার প্রতিটি ভুক্তভোগী পরিবারের দাবি। কোন হত্যাকেই আমরা মাটি চাপা দিতে পারি না।সেখানে এত বড় বড় গণহত্যাকেতো নয়ই। পৃথিবীর ইতিহাসে এত অল্প সময়ে এত ব্যাপক সংখ্যক গণহত্যার ইতিহাস কোথাও নেই।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে পাকিস্তানকে। সর্বোপরি ইতিহাসকে ধরে রাখতে হবে ।গুপ্তযুগ থেকে শুরু করে মুঘল আমল এমনকি ইংরেজ আমলেই ইতিহাসকে গুরুত্ব দিয়ে রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস রচিত হয়েছে। ইতিহাস ধরে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে নিজের গৌরব ও যোগ্যতা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ অতি দ্রুত পৃথিবীর বুকে অর্থনৈতিক, সামাজিক -সাংস্কৃতিক ও তথ্যপ্রযুক্তিতে সারা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এ প্রত্যাশা পুরো বাংলার মানুষের।
আরফানুল জান্নাত
প্রভাষক (ইতিহাস)তরণীর হাট ডিগ্রী কলেজ, গাবতলী ,বগুড়া।