কুষ্টিয়ার জেলার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাচারি বাড়ি’ অযত্ন-অবহেলায়
কে,এম,তোফাজ্জেল হোসেন জুয়েল :-কুষ্টিয়ার জেলার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাচারি বাড়ি’ অযত্ন-অবহেলায় !!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসত বাড়ি
খোকসা – কুমারখালি পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে শিলাইদাহের গায়ে
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসত বাড়ি ইটে বাধান পুকুর ঘাট
দু-ধারে তার বকুল গাছ তারি অঙেগ পংখী কূজন বকুল ফুল আর পাংখি কূজনে
মুখোরিত হয়ে ওঠে ২৫ শে বৈশাখে কবির বাড়ির বাম পাশ ঘেষে…!!
সাদা কাঁশ ফুল বাতাসে দোলে সন্ধা নামিলে ঘন দুর বনে শিয়ালের হাক কানেতে ভাসে
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসত বাড়ি খোকসা – কুমারখালি পদ্মা নদীর তীর ঘেষে
শিলাইদাহের গায়ে পচিশে বৈশাখে শত কোলাহল বাহারি মানুষ আসে মানোব স্রোতে ঢেউ খেলে যায় ।
কবির আঙিগনা দিয়ে পদ্ম নদীর বাকে বিকেল হলেই হাঁসের ঝাক সাঁতরে বেড়াই তাতে
সূর্য ডুবার আগে আওলা বাতাস পাগলা হয়ে সকাল সাঝে ভাসে কবির আঙিগনার ধারে
রাতের বেলায় রুপালী চাঁদ মিটি -মিটি হাসে সূর্য ওঠে সকাল হলেই পাখীর কলরবে
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসত বাড়ি খোকসা -কুমারখালি পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে
শিলাইদাহের গায়ে কবির বাড়ির চার পাশ ঘিড়ে , ইটে বাঁধান ছোট বড় অনেক ছবি
দু- ধারে তার বকুল গাছ গাছের ডালে পংখী কূজন বকুল ফুল আর পংখী কূজনে
মুখরিত হয়ে ওঠে রবি ঠাকুর বাড়িতে রবি ঠাকুরের বাড়ির আঙ্গীনা দিয়ে গোলাপ ফুটে তাকিয়ে
হরেক রং বে রংঙ্গে তার সাথে ফুটেছে হাসনা হেনা চম্পা ও বকুল সন্দর্যের অবকাশে মুগ্ধ হয়ে মন
সারাক্ষন নাচে প্রকৃতি যেনে লুটিয়ে পড়েছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঙ্গিনা ঘিড়ে
বাড়ির আঙ্গিনার গেটে চেরি ফুল দুলিতেছে ,সাঁজের বাতাসের তালে তালে যেন সমস্ত সন্দর্য টুকু
নিয়ে দু-হাত ভরে চাঁদ মামা ফোকলা দাঁতে মিষ্টি করে হাসে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশে
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসত বাড়ি খোকসা-কুমারখালী পদ্মা নদীর তীর ঘেষে
শিয়ালদাহের গায়ে প্রতিদিন স্রোতের ন্যায় বাহারী মানুষ আসে মানব স্রোতে ঢেও খেলে যাই
কবি গুরু রবি ঠাকুরের বাড়ির আঙ্গিনা দিয়ে বিকেল হলেই হাঁসের ঝাক সাঁতরে বেড়ায় তাতে
রাতের বেলায় রুপালি চাঁদ মিটি -মিটি হাঁসে গল্পে -গল্পে রাত কাটিয়ে দেয় তারা কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে
আওলা বাতাস পাগলা হয়ে সকাল সাঝে ভাসে সূর্য ওঠে সকাল হলেই পাখীর কল – রবে ।
থোকায় – থোকায় জোনাক জ্বলে সন্ধা নামার সাথে ঐ দুর বনে শিয়ালটা আজ হাকিছে বারে বারে।।
সারমর্ম কথা :-নোবেল রষ্কার প্রাপ্ত প্রথম বাঙালি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২ হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছিলেন। তাঁর লেখা অসাধারণ সব কবিতা ও গান, আজও প্রত্যেকটা বাঙালীর সমানভাবে মন কাঁড়ে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা “গীতাঞ্জলি” এবং “জীবন স্মৃতি” আজও বাঙালির মনে চির স্মরণীয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ছিলেন ?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাঙ্গালী কবি ,নাট্যকার ,গল্পকার,চিত্রকর,অভিনেতা,দার্শনিক, অভিনেতা, ছোটো গল্পকার । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে কবিগুরু, বিশ্বকবি বিভিন্ন নামে ভূষিত করা হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন সকল দেশের সকল কালের এবং সকল মানবের তীর্থভূমি ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত জীবনী (Rabindranath Tagore Short Biography in Bangali):
নাম (Name) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore)
জন্ম (Birthday) ৭ই মে ১৮৬১, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, কোলকাতা (7th May 1861, Jorasanko Thakurbari, Kolkata)
অভিভাবক (Guardian) / পিতা ও মাতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (বাবা)
সারদাসুন্দরী দেবী (মা)
ছদ্দনাম (Pseudonym) ভানুসিংহ (Vanusingh)
দাম্পত্যসঙ্গী (Spouse) মৃণালিনী দেবী (Mrinalini Devi)
পেশা (Career) কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, গল্পকার
উল্লেখযোগ্য রচনাবলী গীতাঞ্জলী, রবীন্দ্র রচনাবলী, গোরা, আমার সোনার বাংলা, ঘরে বাইরে প্রভৃতি
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার নোবেল পুরস্কার (১৯১৩)
মৃত্যু (Death) ৭ই আগস্ট ১৯৪১ (7th August, 1941)
মৃত্যুস্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, কোলকাতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছিলাে ১৮৬১ খ্রি : ৭ ই মে বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ শে বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর এক অভিজাত ব্রাহ্মন ( ঠাকুর ) পরিবারে । উনিশ শতকের সাহিত্য – সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিলাে এই ঠাকুর পরিবার । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মাতা :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতার নাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর । মাতার নাম সারদা দেবী , তিনি ছিলেন একজন স্নেহময়ী মহিলা । রবীন্দ্রনাথের পিতামহের নাম প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর । তিনি একজন বিত্তশালী জমিদার ও জনহিতৈষী ছিলেন । ঠাকুর পরিবারের শিক্ষা – দীক্ষা , মার্জিত সাংস্কৃতিক চেতনা ও পিতার আলােকিত ধর্মবিশ্বাস কবির মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিলাে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতা – মাতার অষ্টম পুত্র । রবীন্দ্রনাথের প্রায় ১৪ বছর বয়সকালে তার মাতা সারদাদেবীর মৃত্যু হয় ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শৈশবকাল :
শিশুকাল থেকেই অন্যান্য সন্তানদের মতাে রবীন্দ্রনাথ অভিজ্ঞ পরিচারকদের দ্বারা লালিত – পালিত হন । একজন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এবং কয়েকজন গৃহশিক্ষকের কাছে তার প্রাথমিক বিদ্যালাভ শুরু হয় । বিভিন্ন স্কুলেও পড়েন কিছুদিন । কিন্তু স্কুলের বাঁধাধরা নিয়ম ও আবহাওয়া তার মনঃপুত না হওয়ায় বাড়িতেই পড়াশুনার ব্যবস্থা করা হয় । বাড়িতেই বিশ্ববিদ্যার সকল দুয়ার তার সম্মুখে উন্মুক্ত হয়ে গেল ।
শৈশবে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন।কিন্তু বিদ্যালয়-শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করতেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা :
১৮৭৩ সালে এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর তিনি কয়েক মাসের জন্য পিতার সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। প্রথমে তারা আসেন শান্তিনিকেতনে। এরপর পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছুকাল কাটিয়ে শিখদের উপাসনা পদ্ধতি পরিদর্শন করেন। শেষে পুত্রকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ যান পাঞ্জাবেরই (অধুনা ভারতের হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত) ডালহৌসি শৈলশহরের নিকট বক্রোটায় । এখানকার বক্রোটা বাংলোয় বসে রবীন্দ্রনাথ পিতার কাছ থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু করেন। অল্প বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভার উন্মেষ হয় । কিশাের কাল থেকেই শুরু করলেন নিরবচ্ছিন্ন কাব্যচর্চা । মাত্র তেরাে বছর বয়সেই তার প্রথম কবিতা ছাপা হয় তত্ত্ববােধিনী পত্রিকায় ।
১৮৭৮ সালে তিনি পড়াশুনার জন্য বিলেত ( লন্ডন ) যান । তিনি ব্যারিষ্টার হবেন এই অভিপ্রায়ে তাকে লন্ডন পাঠানাে হয় । কিন্তু সেখানে স্বল্পকাল অবস্থানের পরে পাশ্চাত্য জীবনাচরণ , সেখানকার সাহিত্য – সংস্কৃতির খবর ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সুরমূছনা নিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন । বড়ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রেরণায় এবার কবির প্রাণে এলাে গানের জোয়ার । রচনা করলেন অনবদ্য গীতিনাট্য ‘ বাল্মিকী প্রতিভা ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যৌবনকাল :
১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে তার প্রথম বই ‘ কবিকাহিনী ’ প্রকাশিত হয় । তারপর একে একে প্রকাশিত হতে থাকে সন্ধ্যাসঙ্গীত , প্রভাত সঙ্গীত , ছবি ও গান , কড়ি ও কোমল , মানসী , সােনার তরী কাব্যসমূহ । তারপর বের হলাে চিত্রা , চৈতালী , কণিকা , কল্পনা , কথা ও কাহিনী , নৈবেদ্য , খেয়া , গীতাঞ্জলি , গীতালি ইত্যাদি ।
শুধু কাব্যই নয় , নাটক , প্রবন্ধ , গল্প , উপন্যাস , রসরচনা , সমালােচনা , রূপক নাটক , শিশুসাহিত্য , বিজ্ঞান , সমাজতত্ব , শিক্ষাতত্ব , সঙ্গীত , স্কুলপাঠ্য , ভ্রমণকাহিনী , সাহিত্য ও শিল্পের প্রায় সব ক্ষেতেই তার স্বচ্ছন্দ বিচরনের ফলে যােগফল হলাে বাংলা সাহিত্যের বর্তমান চরম উৎকর্ষ সাধন ও উন্নতি । তিনি প্রায় দু’হাজারের মতাে ছবিও এঁকেছেন ।
১৯১২ সালে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় লন্ডনের ইন্ডিয়া সােসাইটি থেকে । সঙ্গে সঙ্গে প্রতীচ্যের বিদগ্ধ সমাজে সাড়া পড়ে যায় । আইরিশ কবি ডব্লিউ . বি . ইয়েস ইংরেজি গীতাঞ্জলির ভূমিকা লেখেন ।
১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশরাজ কবিগুরুকে ‘ নাইট ’ উপাধিতে ভূষিত করেন । ১৯১৯ খ্রীঃ জালিওয়ালাবাগে নিরস্ত্র ভারতীয়দের ব্রিটিশ সৈন্যরা নির্মমভাবে হত্যা করলে তার প্রতিবাদে তিনি ঐ উপাধি । পরিত্যাগ করেন ।
রবীন্দ্রনাথ ইউরােপ , আমেরিকা , চীন , জাপান , রাশিয়া , মালয় , পারস্য প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন এবং এইসব দেশে বহু বক্তৃতা ও রচনা পাঠ করেন । পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষাতেই তাঁর রচনা প্রকাশিত হয়েছে । বিশ্বের সকল দেশের বিদগ্ধ মানুষ , কবি , লেখক , বুদ্ধিজীবীরা তাকে মনীষী হিসাবে শ্রদ্ধা করেন ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্ম জীবন :
ভারতী পত্রিকায় ১৮৭৭ সালে, মাত্র ১৬ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশ করেন। সেগুলো ছিলো ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা আর ভিখারিণী ও করুণা নামে দুটো সুন্দর ছোটগল্প। এগুলোর মধ্যে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পায়।
এরপর ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “কবিকাহিনী”। এছাড়াও পরে তিনি রচনা করেছিলেন “সন্ধ্যাসংগীত” নামক আরেকটি কাব্যগ্রন্থ। “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” নামে লেখা তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা এই কাব্যগ্রন্থেরই অন্তর্গত ছিলো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে :
ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে আশার পর, অবশেষে ১৮৮৩ সালে ৯ই ডিসেম্বর তারিখে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয় বেণীমাধব রায়চৌধুরী নামে ঠাকুরবাড়ির এক অধস্তন কর্মচারীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে । বিয়ের সময় ভবতারিণীর পুণরায় নামকরণ করা হয় এবং তাঁর নাম পাল্টে রাখা হয় মৃণালিনী দেবী ।
পরবর্তীকালে, মৃণালিনী দেবী ও রবীন্দ্রনাথের মোট পাঁচ সন্তান হয় । তাঁদের নাম যথাক্রমে ছিলো- মাধুরীলতা (১৮৮৬–১৯১৮), রথীন্দ্রনাথ (১৮৮৮–১৯৬১), রেণুকা (১৮৯১–১৯০৩), মীরা (১৮৯৪–১৯৬৯) এবং শমীন্দ্রনাথ (১৮৯৬–১৯০৭) ।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এঁদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথ মারা যায় ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্য জীবন :
১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন করেন । দেশী – বিদেশী বহু জ্ঞানী – গুণী ব্যক্তিত্ব এখানে শিক্ষকতা করতেন । আজ তা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় রূপে খ্যাত ।
তাঁর রচিত দুটি সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ” এবং” আমার সােনার বাংলা” যথাক্রমে ভারতের এবং বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতরূপে গৃহিত ও সমাদৃত ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারী পরিচালনার জন্য দীর্ঘদিন বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কাটিয়েছেন । তাঁর সােনার তরী ‘ কাব্যগ্রন্থ এবং বহু ছােটগল্পের রচনার পটভূমি এই শিলাইদহ ।
১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ তার গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার নােবেল পুরস্কার লাভ করেন । তিনিই নােবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় এবং প্রথম এশিয়াবাসী ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষজীবন :
জীবনের শেষ চার বছর ছিল তার ধারাবাহিক শারীরিক অসুস্থতার সময়। এই সময়ের মধ্যে দুইবার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল তাকে। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল কবির। সেবার সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সেরে উঠতে পারেননি। এই সময়পর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি ছিল মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করে সৃজিত কিছু অবিস্মরণীয় পংক্তিমালা। মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল ছিলেন।দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।[১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দের ৭ ই আগষ্ট বিশ্বকবি মহামনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা , জোড়াসাঁকোয় মহাপ্রয়াণে যাত্রা করেন । ২৫ শে বৈশাখের সূর্য ( রবি ) ২২ শে শ্রাবণের সন্ধ্যায় অস্ত যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভ্রমণ :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট বারো বার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন।১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনি পাঁচটি মহাদেশের ত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন।
রবীন্দ্রনাথ যেসকল বইতে তার বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাগুলি লিপিবদ্ধ করে রাখেন সেগুলি হল: য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র (১৮৮১), য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি (১৮৯১, ১৮৯৩), জাপান-যাত্রী (১৯১৯), যাত্রী (পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি ও জাভা-যাত্রীর পত্র, ১৯২৯), রাশিয়ার চিঠি (১৯৩১), পারস্যে (১৯৩৬) ও পথের সঞ্চয় (১৯৩৯)।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মূলত এক কবি। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কাব্যরচনা শুরু করেন। তার প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫২। তবে বাঙালি সমাজে তার জনপ্রিয়তা প্রধানত সংগীতস্রষ্টা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ প্রায় দুই হাজার গান লিখেছিলেন। কবিতা ও গান ছাড়াও তিনি ১৩টি উপন্যাস, ৯৫টি ছোটগল্প, ৩৬টি প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থ এবং ৩৮টি নাটক রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র রচনা রবীন্দ্র রচনাবলী নামে ৩২ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রবর্তিত নৃত্যশৈলী “রবীন্দ্রনৃত্য” নামে পরিচিত।
শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা :
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক বছর আগে বোলপুরের শান্তিনিকেতনে, এক বিশাল জমি কেনেন । সেখানে তিনি ১৮৮৮ সালে একটা আশ্রম ও ১৮৯১ সালে একটা ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ।
বাবার সেই কেনা জমিতে রবীন্দ্রনাথ একটা শিক্ষাকেন্দ্র তৈরী করতে চেয়েছিলেন । তাই প্রথমে তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন “পাঠ্য ভবন” নামে একটা স্কুল, যেটা বাকি সব স্কুলের থেকে বেশ আলাদা ছিলো । কারণ সেই স্কুল ছিলো সম্পূর্ণ খোলা আকাশের নীচে একটা গাছের তলায় ।
পরে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি সেই স্কুলকে আরো বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে সেটাকে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেন । যেটার পরবর্তীকালে নাম রাখেন তিনি “বিশ্বভারতী” যা ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ।
সমাজের পিছিয়ে পরা মানুষদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে তিনি আবার ১৯২৪ সালে আরেকটি শিক্ষাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করেন যেটা ছিলো “শিক্ষা সত্র” । তিনি এই প্রতিষ্ঠান মাত্র ৭ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে শুরু করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধিক কবিতা লিখেছেন।তার মধ্যে রয়েছে ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী, সোনার তরী (১৮৯৪), চিত্রা (১৮৯৬), চৈতালি (১৮৯৬), কল্পনা (১৯০০) ও ক্ষণিকা (১৯০০) কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কিত রোম্যান্টিক ভাবনা।এছাড়াও পলাতকা (১৯১৮) কাব্যে গল্প-কবিতার আকারে তিনি নারীজীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলি তুলে ধরেন।বহির্বিশ্বে তার সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত কাব্যগ্রন্থটি হল গীতাঞ্জলি। এ বইটির জন্যই তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটো গল্প :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ছোট গল্পকার ।তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল “কঙ্কাল”, “নিশীথে”, “মণিহারা”, “ক্ষুধিত পাষাণ”, “স্ত্রীর পত্র”, “নষ্টনীড়”, “কাবুলিওয়ালা”, “হৈমন্তী”, “দেনাপাওনা”, “মুসলমানীর গল্প” ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্প চলচ্চিত্র, নাটক ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। তার গল্পের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রায়ণ হল সত্যজিৎ রায় পরিচালিত তিন কন্যা ও চারুলতা ,তপন সিংহ পরিচালিত অতিথি, কাবুলিওয়ালা ও ক্ষুধিত পাষাণ, পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত স্ত্রীর পত্র ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট তেরোটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এগুলি হল: বৌ-ঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩), রাজর্ষি (১৮৮৭), চোখের বালি (১৯০৩), নৌকাডুবি (১৯০৬), প্রজাপতির নির্বন্ধ (১৯০৮), গোরা (১৯১০), ঘরে বাইরে (১৯১৬), চতুরঙ্গ (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯), শেষের কবিতা (১৯২৯), দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪)। রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা হল বৌ-ঠাকুরাণীর হাট ও রাজর্ষি ।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট ও রাজর্ষি ঐতিহাসিক উপন্যাস। চোখের বালি উপন্যাসে দেখানো হয়েছে সমসাময়িককালে বিধবাদের জীবনের নানা সমস্যা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরে ও ঋতুপর্ণ ঘোষের চোখের বালি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাট্য সাহিত্য :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে ছিলেন নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক নাট্যমঞ্চে মাত্র ষোলো বছর বয়সে অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত হঠাৎ নবাব নাটকে ও পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরই অলীকবাবু নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৮১ সালে তার প্রথম গীতিনাট্য বাল্মীকিপ্রতিভা মঞ্চস্থ হয়।এই নাটকে তিনি ঋষি বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক দর্শন :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক দর্শন অত্যন্ত জটিল। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বর্জন করেন।নাইটহুড প্রত্যাখ্যান-পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।” রবীন্দ্রনাথের “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য” ও “একলা চলো রে” রাজনৈতিক রচনা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। “একলা চলো রে” গানটি গান্ধীজির বিশেষ প্রিয় ছিল।যদিও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। হিন্দু নিম্নবর্ণীয় জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজি ও আম্বেডকরের যে মতবিরোধের সূত্রপাত হয়, তা নিরসনেও রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গান্ধীজিও তার অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠান সমূহ :
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় : ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরে অবস্থিত।
রবীন্দ্র সেতু: রবীন্দ্র সেতু (পূর্বনাম হাওড়া ব্রিজ) হুগলি নদীর উপর অবস্থিত কলকাতা ও হাওড়া শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতুগুলির মধ্যে অন্যতম হল রবীন্দ্র সেতু। ১৮৭৪ সালে প্রথম হাওড়া সেতু নির্মিত হয়। পরে ১৯৪৫ সালে পুরনো সেতুটির বদলে বর্তমান বহির্বাহু সেতুটির উদ্বোধন হয়। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন সেতুটির নাম পরিবর্তন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে রবীন্দ্র সেতু রাখা হয়।
রবীন্দ্রসদন: পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত একটি ঐতিহ্যবাহী সরকারি প্রেক্ষাগৃহ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হল রবীন্দ্রসদন (পূর্বনাম রবীন্দ্রস্মরণী) । এটি দক্ষিণ কলকাতার নন্দন-রবীন্দ্রসদন সাংস্কৃতিক চত্বরে অবস্থিত।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়: কলকাতার একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬২ সালের ৮ মে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল এই বিশ্ববিদ্যালয়।
রবীন্দ্রনাথের পুরষ্কার এবং অর্জনসমূহ :
১৯৪০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যাল)য় তাঁকে শান্তিনিকেতনে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে “ডক্টরেট অব লিটারেচার” সন্মানে ভূষিত করে ।
বিদেশে তাঁর রচিত গীতাঞ্জলী কাব্য, বিশেষ জনপ্রিয়তা পায় । সেই সুবাদে তাঁকে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দিয়ে সন্মানিত করা হয় ।
১৯১৫ সালে তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নাইট উপাধি পান । কিন্তু ১৯১৯ সালে ঘটে যাওয়া জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের পর তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন ।
১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের আঁকা একটা ছবি, প্যারিস ও লন্ডনে প্রদর্শিত হয় ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপানের ডার্টিংটন হল স্কুলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ।
৭ই মে ১৯৬১ সালে, ভারতীয় ডাকবিভাগ সম্মান জ্ঞাপনের উদেশ্যে; তাঁর ছবি দেওয়া একটা ডাক টিকিট প্রকাশ করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে আশ্চর্যজনক তথ্য :
মাত্র আট বছর বয়স থেকেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন ।
তিনি চিরাচরিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে একদম তুচ্ছ মনে করতেন এবং সেই চিরাচরিত শিক্ষার অধীনে থেকে পড়তে ভালোবাসতেন না ।
তিনি ভারতীয় সাহিত্য ও কলায় বিপ্লবের উদ্দেশ্যে, বাংলায় নবজাগরণ আন্দোলন শুরু করেছিলেন ।
বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক সত্যজিৎ রায়, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক কর্মকান্ডে বিশেষভাবে প্রভাবিত হন । “পথের পাঁচালী” সিনেমায় পরিচিত সেই ট্রেনের দৃশ্য, আসলে কবিগুরু রচিত “চোখের বালিতে” বর্ণিত একটা ঘটনার থেকে অনুপ্রাণিত ছিলো ।
রবীন্দ্রনাথ একজন মহান সুরকারও ছিলেন । তিনি প্রায় দুই হাজারেরও বেশি গান নিজে রচনা করেছিলেন ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু :
জীবনের শেষ কিছু বছর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধারাবাহিক ভাবে শারীরিক অসুস্থতার শিকার হন । রোগ যেন তাঁকে কিছুতেই ছাড়তেই চাইছিলো না । দুবার তো তিনি এমন অসুস্থ হন, যারজন্য তাঁকে বহুদিন বিছানায় শয্যাশায়ী অবস্থায় পরে থাকতে হয় ।
জানা যায় ১৯৩৭ সালে কবি একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থার শিকার হন । যদিও তিনি সেইসময় সেবার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন ঠিকই কিন্তু ১৯৪০ সালে আবার গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর তিনি আর সেরে উঠতে পারেননি ।
অবশেষে দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট তারিখে, জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি । মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিলো প্রায় ৮০ বছর ।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর স্মৃতিধন্য কুষ্টিয়া। রবীন্দ্রনাথ তাঁর যৌবনকালের একটি উল্লেখযোগ্য সময় এখানে কাটিয়েছেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ গ্রামে। জেলা শহর থেকে প্রায় ২০কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদীর কোল ঘেঁষে গ্রামটির পূর্ব নাম খোরশেদপুর।
রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭সালে এ অ লের জমিদারি পান। পরবর্তিতে ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে জমিদার হয়ে আসেন। এখানে তিনি ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারী পরিচালনা করেন। এ সময় এখানে বসেই তিনি রচনা করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, গীতাঞ্জলি ইত্যাদি। এখানে রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে এসেছেন জগদীশ চন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরীসহ আরো অনেকে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে যে শুধু সাহিত্য চর্চা করেছেন তা নয়। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি মানব কল্যাণে দরিদ্র জনগণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিবিড় সেতুবন্ধন স্থাপন করেছিলেন। তিনি মানব কল্যাণে স্থাপন করেছিলেন কাচারি বাড়ি ও দাতব্য চিকিৎসালয়।
কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শিলাইদহ কাচারি বাড়ি ও দাতব্য চিকিৎসালয়টি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অযত্ন আর অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বিশ্বকবির স্মৃতি বহনকারী ঐতিহাসিক এই কাচারি বাড়ি। ইতোমধ্যে কাচারি বাড়ির বিভিন্ন আসবাবপত্রসহ দরজা ও জানালা চুরি হয়ে গেছে। অনেকটা ধ্বংস পথে বিশ্বকবির স্মৃতি বহনকারী ঐতিহাসিক কাচারি বাড়ি ও তার প্রতিষ্ঠিত দাতব্য চিকিৎসালয়টি।
জানা যায়, শিলাইদহের এ কাচারি বাড়িতে বসেই রবীন্দ্রনাথ তার পৈতৃক জমিদারির খাজনা আদায় করতেন। তার সেই স্মৃতি বিজড়িত কাচারি বাড়িকে স্থানীয়রা এখন গোবরের ভাগারে পরিনত করেছেন। এই অবস্থায় কুঠিবাড়িটির মতো বিশ্বকবির স্মৃতি বিজড়িত এই দুটো স্থাপনা সংরক্ষণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে কবিগুরুর ভক্ত ও অনুরাগীরা ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহ কুঠিবাড়ি বেশ আগে থেকেই পুরো বাংলাদেশেসহ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলেও, কুঠিবাড়ির মাত্র ৫০০ মিটার দূরে অবস্থিত কাচারি বাড়ি ও দাতব্য চিকিৎসালয়টির খোঁজ কেউ রাখে না।
রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত এই কাচারি বাড়িটি অনেকটা মানুষের চোখের আড়ালেই রয়ে গেছে। ১৮৯১ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর এই বাড়িতে বসেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারির খাজনা আদায় করেতেন। তৎকালিক পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) শিলাইদহ ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারির মূলকেন্দ্র। কালের বিবর্তনে সেই জমিদারি আর এখন নেই, নেই খাজনা দেওয়ার লোকজনও।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহের কাচারি বাড়িটি বাঙালি জাতির জন্য একটি অমূল্য সম্পদ। কিন্তু অবহেলায় আর অযত্নে এ বাড়িটি দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অথচ ঠিকমতো সংস্কার ও সংরক্ষণ করা হলে এই কাচারি বাড়িটিও পর্যটনকদের কাছে আর একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হতো। এর ফলে এ কাচারি বাড়িটি হয়ে উঠতো সরকারের রাজস্ব আয়ের একটি নতুন উৎস হিসেবে। কয়েক বছর আগেও এ কাচারি বাড়িতে শিলাইদহ ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। শিলাইদহ ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণের ফলে বর্তমানে ইউনিয়ন ভূমি অফিস সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ কারণে কাচারি বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত জারাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বর্তমানে কাচারি বাড়িটি স্থানীয় লোকজনের গোবরের লাকড়ি শোকানোর স্থানে পরিণত হয়েছে। বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গা পরিনত হয়েছে গরু, ছাগলের চারণ ভূমিতে। দাতব্য চিকিৎসালয়ের ভাঙা চারটি কক্ষের মধ্যে দুটি কক্ষের ছাদ সংস্কার করা হলেও কাচারি বাড়িটির এখনো কিছূই করা হয়নি। এর ফলে কাচারি বাড়ির পলেস্তারা, বারান্দাসহ কয়েকটি কক্ষের ছাদের কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে। কিছু কিছু জায়গার ইট খসে পড়েছে। দেয়ালের গায়ে জন্মেছে বট, পাকর গাছ, আগাছায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। বিশ্বকবির কাচারি বাড়িটিতে পাঁচ একর জমি রয়েছে।
বিশ্বকবির কাচারি বাড়ি ও দাতব্য চিকিৎসালয়টিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে নোটিশ টাঙিয়ে রাখলেও কেউ মানছে না নোটিশে আরোপি নিষেধাজ্ঞা।
কবি ও নাট্যকার লিটন আব্বাস বলেন, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত কাচারি বাড়ি ও দাতব্য চিকিৎসালয়টি ঐতিহ্য। এসব স্থাপনার সংরক্ষণ করা উচিত। এসবের অর্থনৈতিক মূল্য না থাকলেও এর ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। কাজেই এসব স্থাপনা আবার পূর্বের রূপে ফিরিয়ে দেওয়া গেলে যেমন পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে তেমনি এ দেশীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে দেশ বিদেশের মানুষ জানতে পারবে।
এ বিষয়ে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিতান কুমার মন্ডল বলেন, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত কাচারি বাড়িটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এই বাড়ির সংস্কার করে ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত এই কাচারি বাড়িটি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। খুব দ্রুতই কাচারি বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ শুরু করা হবে।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) কলা বিভাগের ডিন ও রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক ড. সরোওয়ার মুর্শেদ বলেন, রবীন্দ্রনাথ আমাদের আবেগের জায়গা। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ কাচারি বাড়ি ও মহৌষি দাতব্য চিকিৎসালয়টিকে শুনেছি পুরাকীর্তি বিভাগ অধিগ্রহণ করেছে। অতি দুঃখের বিষয় পুরাকীর্তি হিসেবে এগুলো যে নিয়েছে তার প্রতিফলন কিন্তু আমরা দেখছিনা। আমরা চাই রবীন্দ্রনাথের অমূল্য যে স্মৃতি সেগুলো বাঙালি জাতির জন্য, বাঙালি পর্যটকদের জন্য, বিদেশী পর্যটকদের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটাকে আকর্ষনীয় করে গড়ে তুলবেন বলে আমরা আশা রাখি।
এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনার আ লিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা জানান, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহ কাচারি বাড়ি ও দাতব্য চিকিৎসালয় সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কাজ করছে। কাচারি বাড়িটির মূল ভবনের কয়েকটি কক্ষ ও বারান্দার ছাদ ভেঙে গেছে।
তিনি আরও বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বরাদ্দ দিয়ে ভেঙে যাওয়া ওই ছাদ সংস্কার করাসহ অন্যান্য কাজ করা হবে। পর্যায়ক্রমে পুরো ভবনটাই আগের রূপে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
প্রত্নতত্ত্বের এই আ লিক কর্মকর্তা বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে শুধুমাত্র কাচারি বাড়ির বিল্ডিং ও দাতব্য চিকিৎসালয়ের বিল্ডিং দেওয়া হয়েছে আমরা পাশের আর কিছু খাস জমি চেয়েছি যাতে করে এসব স্থাপনাগুলোর চারপাশে প্রাচীর দিয়ে রক্ষা করতে পারি। আমরা ইতোমধ্যে দাতব্য চিকিৎসালয়ের বেশ কিছু কাজ করেছি। খুব শিগগিরই বিশ্বকবির স্মৃতি বিজড়িত কাচারি বাড়িটিকেও আমরা আগের রূপে দেখতে পারবো।