লাল সবুজের পতাকা
জিল্লুর রহমান লালন
কবি গালিব কয়েকদিন যাবত একটি গল্প লেখবে বলে ভাবছে। কিন্তু গল্পের কোন প্লট দাড় করাতে পারছে না। নিজের প্রতি বিরক্ত হয় সে। লেখালেখির টেবিল থেকে উঠে পড়ে। বুক শেলফ থেকে বই বের করে। বই পড়তে বসে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর আর ভালো লাগে না। বই রেখে উঠে পড়ে । রুমের ডিম লাইটটা জ্বেলে দরজাটা ভিজিয়ে রেখেই বাইরে যায় সে। রাতের মেঘমুক্ত তারা ভরা আকাশ আর শীতল বাতাসে হাটতে ভালো লাগে তার। কিছুক্ষণ আনমনে হাটল সে। কিন্তু কিছুতেই গল্পের শুরুটা করতে পারল না। অনেকটা নিজের প্রতি বিরক্ত হয়েই ঘরে এসে শুয়ে পড়ল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে সাইড ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে ছুটল পত্রিকা অফিসের উদ্দেশ্য। আগের কয়েকটি লেখার সম্মানি পাওয়ার প্রত্যাশায়। পথে যেতেই শাহবাগের মোড়ে এক বৃদ্ধ পতাকা বিক্রেতাকে দেখলেন। মলিন চেহারা, মাথার চুলগুলো এলোমেলো,মুখে লম্বা দাড়ি, কেন জানি তাকে দেখে কবি গালিবের ভেতরে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হলো। মনস্থির করল, এই পতাকা বিক্রেতাকে নিয়েই একটা গল্প লিখব।
পত্রিকা অফিস থেকে কাজ সেরে তাড়াতাড়ি ফিরে এলো শাহবাগের মোড়ে। পতাকা বিক্রেতার নিকট এসে সালাম দেয় সে। সালামের উত্তর দিয়ে পতাকা বিক্রেতা বলেন, “স্যার আপনার কোন সাইজের পতাকা লাগবে? বাসা বাড়ি, গাড়ী নাকি অফিসিয়াল সাইজ??
চাচা, আমি আসলে পতাকা কিনব না। আপনার সাথে আমি একটু গল্প করতে চাই। আপনার কী একটু সময় হবে ?
তা আর হবে না কেন? এখন খু্ব বেশি বেচা -বিক্রি নাই। সারাদিন প্রায় বসেই কাটাই। তা বলো বাবা, কি বলতে চাও!
আপনার নামটা যেন কী চাচা ?
বাবা – মায় আমার নাম রেখেছিল মনোয়ার হোসেন। গরীব মানুষের নাম! মনোয়ার না বলে সবাই মনা বলেই ডাকত। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি নাকি পাগলামি করতাম তাই সবাই মনার সাথে পাগলা যোগ করে মনা পাগলা বলে ডাকে। নাম দিয়ে কি হবেরে বাপ? কাম যদি ভাল না করি ভাল নাম নিয়ে কোন লাভ নেই।
আচ্ছা আপনি পাগল হয়ে ছিলেন কিভাবে ?
সে তো অনেক কথারে বাপ।যখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন আমার বাবা- মা মারা যায়। তিন ভাই আর দুই বোনের দায়িত্ব পরে আমার উপর। পেশা হিসাবে বাবার টেইলারিং পেশাই বেছে নিলাম। টেইলার হিসাবে অল্প দিনেই সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বেশ ভালোই চলছিল।
আমি কী পাগল ছিলাম নাকি? আমি পাগল সেজে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষন শুনে প্রচন্ড আওয়াজে “জয় বাংলা ” শ্লোগান দিয়ে ছিলাম। আর বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দোয়া করতে গিয়ে হু- হু করে কেঁদেছিলাম। অনেকেই আমাকে দেখে বলেছিল লোকটা পাগল নাকি? তখনই আমার মনে হয়েছিল আমি তো সত্যি পাগল! আমি বঙ্গবন্ধুর পাগল, লাল সবুজের পতাকার পাগল, আমি জয় বাংলার পাগল।
আপনি পাগল সেজে কিভাবে যুদ্ধ করতেন?
আমি পাগল সেজে পথে পথে ঘুরতাম আর পাক বাহিনীর অবস্থান জানতাম এবং মুক্তি বাহিনীর কাছে জানাতাম। মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতাম। মুক্তিবাহনীর শিবিরে শিবিরে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। শুধু এরকম পাগল মুক্তি যোদ্ধাই ছিলনা।কতজন বাউল বেশে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করত। কেউবা ফকিরের বেশে যুদ্ধ করত।কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সুখচাঁদ বয়াতী,খোকসার বীরু ফকির, পাংশার দুলাল দেওয়ান এরা সবাই বাউল বেশে যুদ্ধ করত।
আপনি পতাকা বিক্রি শুরু করলেন কবে থেকে?
আমি যখন বুঝতে পারলাম বিজয় খুবই সন্নিকটে। বিভিন্ন জেলা শত্রুমুক্ত হতে শুরু করেছে। তখনই আমি অনুভব করলাম বিজয়ের পতাকার। পাগল বেশেই কয়েকজন কাপড় ব্যবসায়িকের কাছ থেকে কাপড় এনে রাতের অন্ধকারে আমার বস্তি ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে তৈরি করতাম হাজার হাজার পিচ লাল সবুজের পতাকা । আমার বানানো পতাকাগুলো ছড়িয়ে দিতাম মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে ক্যাম্পে। দেশ স্বাধীন হলে জীবন ও জীবীকার জন্য এই পতাকা বিক্রিই বেছে নিলাম।
আপনার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন কোনটি?
১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১।সেদিন চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনীরা বাংলাকে শত্রুমুক্ত করে বীরের বেশে লাল সবুজের পতাকা উড়াতে উড়াতে ঢাকা এসে হাজির হলো। যে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন সেই ময়দানেই পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য দেখে আনন্দে আমার চোখে জল এসে গিয়ে ছিল। স্বাধীন দেশে মুক্ত আকাশে যখন বাংলার লাল সবুজের পতাকা উড়তে দেখি তখন গর্বে আমার বুক ভরে যায়।
চাচা , কখন পতাকা বেশি বিক্রি হয়?
১ লা বৈশাখ, ২১শে ফেব্রুয়ারি,৭ই মার্চ, ২৬শে মার্চ এবং ১৬ ই ডিসেম্বরে পতাকা বেশি বিক্রি হয়। তাছাড়া যেদিন বাংলাদেশের খেলা থাকে সেদিনও পতাকা বেশি বিক্রি হয়।
চাচা, আপনাকে কী একটু পা ছুঁয়ে সালাম করতে পারি?.
কেন – রে বাপ! আপনার মত একজন মুক্তিযোদ্ধার পায়ের ধূলো পেলে নিজেকে ধন্য মনে করব। একথা বলেই পা ছুয়ে সালাম করল কবি গালিব । মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধ মনা পাগলা গালিবকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ মুছলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তোমার
শ্রদ্ধা আর ভালবাসা দেখে মনে হয় আরও কিছু দিন বেঁচে থাকি।
সত্যি কথা কি জানেন চাচা,আজকাল রাষ্টীয় সুযোগ সুবিধা নেওয়ার জন্য কত মুক্তিযোদ্ধা কর্তা ব্যক্তিদের কাছে তদবির করছে। আপনি এই বৃদ্ধ বয়সেও পতাকা বিক্রি করে জীবন চালাচ্ছেন।
সুযোগ সুবিধার জন্য তো যুদ্ধ করিনি বাবা।পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে নিজের প্রয়োজনেই যুদ্ধে গিয়েছি।
সত্যি চাচা, আপনাকে পেয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। আসলো প্রকৃত যোদ্ধারা সবসময় নির্লোভ আর নির্মোহ হয়। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ চাচা।
তোমাকেও ধন্যবাদ বাবা।
এবার কবি গালিব ফিরল বাসার পথে। পথে হাটতে -হাটতে ভাবল গল্প কবিতার কত উপাদান ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে। আমাদের চর্ম -চক্ষু যা দেখতে পায়না।