এগারো বছরে বাংলা একাডেমি কেন অন্ধকারে?
অথই নূরুল আমিন
দেশের 18 কোটি মানুষের স্বপ্নের ফসল খ্যাত বাংলাদেশে বাংলা ভাষা, ভাষার ইতিহাস, বাঙালির কৃষ্টি,সাহিত্য এবং সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষণা প্রকাশনা ও সংরক্ষণ ধর্মী প্রথম শ্রেণির এই প্রতিষ্ঠানটি আজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কেন?
কেনই বা এই প্রতিষ্ঠানটির রোগা রোগা ভাব। আমি একজন লেখক, কবি,সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট তাই প্রায় সময় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে যাওয়া আসা হয়। 90 দশকে প্রচুর কবিতা রচনা করেছি। 90 দশকের মানবতার কবি হিসেবে বন্ধুরা আখ্যায়িত করে। জীবনে অসংখ্য পুরষ্কারে ভুষিত হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন আর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ছিল বেশি আসা-যাওয়া। তখন আমি যুবক ছিলাম।
বাংলা একাডেমির পুকুরপাড়ে তখন বসতে গিয়ে কমপক্ষে চারটা পেপার বিছানো প্রয়োজন ছিল, আজও তাই। বাংলা একাডেমিতে গেলে তার চারপাশে নোংরা,ময়লা ও আবর্জনা দেখলে নিজেকে বাঙালি হিসেবে ভাবতে খুব কষ্ট লাগে।
প্রধানমন্ত্রী,বাংলা একাডেমির এ প্রতিষ্ঠানটি সরকারের পক্ষ থেকে কে বা কারা দেখাশোনা করে তা এখনো জানা যায়নি। এই প্রতিষ্ঠানটি নাকি স্বায়ত্তশাসিত তাই বলে কোনো কাজে অকাজে কোনো জবাবদিহিতা নেই। তাই বলে কি,কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবে এমন লোক সরকারের নেই?
বাংলা একাডেমি 1955 সালের 3 ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করা হলেও স্বাধীনতার পর থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি বাঙালি জাতির মেধা ও মননের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এই একাডেমির যত কার্যক্রম দেখেছি। যতজন মহাপরিচালক দেখেছি। সবাই চলছে মান্ধাতার আমলের চিন্তা ও ভাবনা নিয়ে।
তবে আমি এই একাডেমির যতজন মহাপরিচালক স্বচক্ষে দেখেছি, পাশাপাশি চলেছি, তারা সবাই বড় দাম্ভিক হয়। তারা মনে করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মানে মহাপুরুষ। জগৎখ্যাত না হোক তারা নিজেকে মহাপুরুষ মনে করে। তাই এই একাডেমির আজীবন করুণ এক অবস্থা।
আমি তো বড় গলায় জোর দিয়ে বলতে পারি বাংলা একাডেমি একটি জ্ঞানের ভান্ডারে যেন জ্ঞান প্রতিবন্ধী পায়ে শিকল বাঁধা একটি প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পরেও দেশের 90 ভাগ মানুষ প্রকৃত অধিকারের ব্যাপারে অবগত নয়। মেট্রিক পাস ছেলে মেয়েরা অনেকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি অধিকারের কথা বলতে পারে না। মানবিক আচরণ সম্পর্কে অনেকের ন্যূনতম ধারণা নেই।
দেশের এক কোটি যুবক যুবতীর জন্য যখন অর্থমন্ত্রী প্রসঙ্গে পত্র লিখি সবার জন্য তিন লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার জন্য বলি। ফেসবুকে পোস্ট দেই। তখন সারা দিনে 50 টা লাইক, তিনটা শেয়ার, একটা কমেন্ট হয়।
বাঙালি জাতির স্বভাব ব্যাঙের চরিত্র হয়েছে অনেকের। ঘরে নিয়ে দিবেন তো সে গ্রহণ করবে। এটা অধিকার হিসেবে চেষ্টা করতে চায় না।
তবে বাংলা একাডেমিতে পূর্বে যা ঘটেছে তা নিয়ে আমার আজকের এই আলোচনা নয়। আমি আওয়ামী লীগ সরকারের গত 11 বছরে প্রধানমন্ত্রীকে বারবার বলেছি, চিঠি দিয়েছি, বাংলা একাডেমিতে একজন দক্ষ উন্নয়ন পরিচালক নিয়োগ দেন।
বাংলা একাডেমি বছরে একটি বইমেলার আয়োজন করে। এটাই তারা একটি বাহাদুরি মনে করে। বইমেলা বড় করতে করতে সামনে উদ্যানে নিয়ে গেছে। এটা সরকারের উন্নয়নের ফসল।
আমার প্রশ্ন হল, সামনের এ উদ্যানটি যদি কোনো কারণে না থাকতো, তাহলে এই জ্ঞান প্রতিবন্ধী বাংলা একাডেমি কি করত? হয়তো বলতো তারা নিরুপায়!
এই উদ্যানে বইমেলার সময় ঝড়, তুফান ও বৃষ্টি হলে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রকাশনীর বই নষ্ট হয়। প্রকাশক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি বছরে একবার আসেন বইমেলা উদ্বোধন করতে। তারপর আপনার সেখানে আর যাওয়া হয় না। এই একাডেমি চারপাশ ঘুরে এসে কেউ যদি আপনার কাছে সঠিক রিপোর্ট করে। তাহলে লেখা থাকবে এটা গ্রামের কোন বড় বাড়ির অগোছালো একটি গোয়াল ঘর।
জ্ঞান প্রতিবন্ধী একাডেমি এতোই জ্ঞান প্রতিবন্ধী যে ওখানে সৌন্দর্যের আধুনিকতা এবং দীর্ঘ উন্নয়ন পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না কখনই। সারা জীবন ভিক্ষুকের মতো নাই নাই অবস্থা।
এখান থেকে একজন লেখক বা লেখিকা সারা জীবন তপস্যা করে যদিও একবার পুরস্কার পায় তারপর এই পরিবারটি কোনো দুর্ঘটনায় পড়লে বাংলা একাডেমি আর তাদের পাশে দাঁড়াতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী নিচের লাইনটির খবর আপনি জানলে সত্যিই অবাক হবেন যে, বইমেলা চলা অবস্থায় প্রত্যেক লেখকের একটি করে বই একাডেমির তথ্য কেন্দ্রে জমা দিতে হয় । এমন একজন লেখক তার তিন রকম তিনটি বই নিয়ে তথ্য কেন্দ্রে গেলেন জমা দিতে। তখন তথ্যকেন্দ্রের একজন মহিলা একটি ফটোকপি ফরম দিয়ে বলল বাকি দুইটা ফরম ফটোকপি করে নিতে হবে? যেখানে তিনটে বইয়ের মূল্য 590 টাকা। এখানে তিনটা ফটোকপি ফরম দিতে ব্যর্থ।
আপনি বলেন এই একাডেমিকে নিয়ে এই জাতি কি আশা করতে পারে? দেশের 90 ভাগ লেখক-লেখিকা এদের কাছে কোন না কোনভাবে নির্যাতিত।
বই মেলায় সবসময় কোনো না কোনো কোম্পানি বা ব্যাংক স্পন্সার হয়, কেন? বাংলা একাডেমি বলে কথা! বর্তমানে দেশের 18 কোটি মানুষের মেধা ও মননের এই প্রতিষ্ঠানটি তার নিজস্ব গতিতে নিজস্ব অর্থায়নে শুধুমাত্র একটি বইমেলা তাদের মতো করে সাজাতে ব্যর্থ। ছি বাংলা একাডেমি…ছি!
এমনকি বিল্ডিংগুলো ঐ সময় রং করানো হয় না। বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য একটি বিল্ডিং নেই? মেলা চলা অবস্থায় গান, নৃত্য আলোচনার মঞ্চটি ও মানহীন?
লেখক কুঞ্জ ঘরটি যেন বাবুই পাখির বাসার মত ছোট্ট থাকে। একটি প্রকাশনী যদি বাংলা বাজার থেকে বই প্রকাশ করে কোটি কোটি টাকার মালিক হতে পারে
তাহলে বাংলা একাডেমি কী করে?
বাংলা একাডেমি যদি বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করে, তাহলে এক বছরেই অনেক কিছু করা সম্ভব। জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী বলে কথা। এখানে থাকবে তাদের নিজস্ব স্বাধীনতা। থাকবে ভেতরে পরিছন্নতা। সমগ্র বাংলা একাডেমির জায়গা জুড়ে গড়ে উঠবে মুজিব বর্ষ উপলক্ষে 15 তলা বিশিষ্ট ডিজিটাল টাওয়ার। থাকবে নিজস্ব টেলিভিশন সেন্টার, রেডিও সেন্টার, থাকবে বিশ্বজুড়ে বই বিক্রয় ডট কম।
পাশে থাকা পুকুরটি হবে পর্যটন কেন্দ্রের অংশবিশেষ। থাকবে তাদের নিজস্ব হোস্টেল। দেশী বিদেশী লেখকদের সম্মানে করা হবে আমন্ত্রণ। বাংলা একাডেমির অবস্থা থাকতে হবে স্রোতসিনি নদীর মতো। একটি প্রকৃত স্রোতসিনি নদী মানবকল্যাণের যেমন বহুবিধ বড় ধরনের ভূমিকা রাখে তার চেয়েও বড় ধরনের ভূমিকা থাকা দরকার বাংলা একাডেমির।
আমি প্রধানমন্ত্রীকে আরো বলেছিলাম,বাংলা একাডেমি এমন সম্ভাবনাময় একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে একজন দক্ষ উন্নয়ন পরিচালক নিয়োগ দিলে এক বছরের মধ্যে 15 তলা বিশিষ্ট মুজিব ডিজিটাল টাওয়ার, নিজস্ব টিভি সেন্টার, রেডিও সেন্টারসহ নানান সুবিধা করা সম্ভব।
যা করতে গিয়ে সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থ বা অর্থমন্ত্রীর বাজেট কোনো প্রয়োজন নেই। রাজস্ব বোর্ডের অর্থ ছাড়াই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এবং উন্নত একটি প্রতিষ্ঠান করে বিশ্বমিডিয়ায় সুনাম এবং গিনেস বুকে নাম লেখানো সম্ভব!
প্রধানমন্ত্রী আপনাকে অবগত করতে চাই গত 11 বছরে বাংলা একাডেমিতে কোনরকম উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি ইহা বড় দুঃখজনক!
লেখক : প্রধানমন্ত্রীর মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা।