ধোকা
রোমানুর রোমান
-‘ভাইয়া! এই ভাইয়া… তুই কিন্তু আমাক একটা লাল টুকটুকে ভাবি এনে দিবি।’
-‘ধুর পাগলী, তুই আনতে পারিস না! তোর ভাবী আমি আনতে যাবো ক্যান? ‘
-‘আরে আমার ভাবি মানে তোর বউ। তোর বউকে তো তুই আনবি। তাই না?’
-‘ আমার বউ- তা আমি লাল টুকটুকে আনি নাকি কালা কুচকুচে আনি সেটা আমার ব্যাপার। তোর কী?’
-‘না- না, ভাইয়া লালটুকে বউ আনবি, প্লিজ। আমার ভাবি হবে মিষ্টি একটা ভাবি। যেমন-তেমন ভাবি আনলে কিন্তু আমি কথা বলবো না, আর তোর বোন হবো না কখনো! হু’
বিকেলে বাসার ছাদে এভাবেই দুষ্টু- মিষ্টি- অভিমানে কথা হচ্ছিলো ভাই-বোনের মধ্যে। বয়স পনেরো হলেও রোজা সবসময় মাতিয়ে রাখতো বড়ভাই ফাহিমকে। সে কথা-বার্তায় যেমন এগিয়ে তেমনি অন্য দিকেও। যেমন এই বয়সে সে ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়ে।
আর ফাহিমের বয়স তখন উনিশ, সে মাত্র ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। বিয়ে তো অনেক দূরের কথা একটা প্রেম পর্যন্ত করতে পারেনি।
রোজার অভিমানী কথা শুনে সে হেসে বললো- আমার যে পোড়া কপাল! এমন লাল টুকটুকে মেয়ে কোথায় পাবো বল!’
রোজা বললো- খুঁজবি। মন দিয়ে খুঁজলে কী না পাওয়া যায়!’
-‘তাহলে তুই খুঁজে দিস। আমার দ্বারায় হবে না।’
-‘আমি খুঁজে দিলে কী তোর পছন্দ হবে? যদি না হয়!’
-‘অবশ্যই হবে। আমার কলিজার টুকরা বোনটার পছন্দ; আমার পছন্দ হবে না, এটা হতে পারে?’
-‘ঠিক আছে ভাইয়া। কলেজে খুঁজবো তাহলে লাল টুকটুকে একটা মিষ্টি মেয়ে। পেলে জানাবো কেমন?’
-‘ হুম ঠিক আছে।’
রোজা ছাদ থেকে নেমে নিজের বেডরুমে গিয়ে তার ফোনে তাকিয়ে দেখে এগারোটা মিসকল। ঘোলাটে দুধের সাদা স্কিনে কালো অক্ষরে লেখা “এগারো মিসড কল”। নাম্বারটি জনি নামে সেভ করা।
সে অধীর আগ্রহে প্রিয়জনের কল্পতরুর পঙক্তিমালা শোনার জন্য বসে আছে যেনো। তা না হলে তো এতোবার স্মরণ করার কথা না! রোজা এক মাইক্রসেকেন্ড কার্পণ্য না করে জনিকে ফিরতি কল করে।
জনি তার পাগলাটে প্রেমিক। ইউনিভার্সিটির ৩য় বর্ষের ছাত্র।
ফোন রিসিভ করেই তার প্রশ্নবিহীন প্রেমালাপ।
সে আর বারোটা প্রেমিকের মতো না যে, প্রেমিকার একটু ব্যস্ততাতে সন্দেহ করবে! ঝাড়ি দিয়ে কৈফিয়ত চাইবে!
হয়তো ঐ সময়ে প্রয়োজনীয় মানুষটিকে না পেলে খুবি অস্থিরতা লাগে। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে, মানুষটির সমস্যাও থাকতে পারে।
পাগল ছেলেটির ভাবনা- কোনো কারণে হয়তো রোজা ব্যস্ত ছিলো। কি করছিলো সেই প্রশ্ন করে খামাকা সময় নষ্ট করতে চাই না। আগে ব্যক্ত হোক যতো পঙক্তিমালা, রপ্ত হোক কথা বলা, তারপর নাহয় প্রশ্ন করি- বিশ্বাসে থাক পূর্ণ ষোলোকলা।
জনি এমনই পাগলাটে প্রেমিক। তার শুধু হৃদয় না; যেনো পুরো শরীরেই ভালোবাসায় পূর্ণ।
প্রতিদিন রোজা টিফিনের আড্ডায় খুঁজতে থাকে ভালো কোনো মেয়ে। বান্ধবীদের কাছে হর-হামেশাই গুণকীর্তন করতে থাকে আপন ভাইয়ের। তবে কখনো নিজের প্রেমিকের কথা কাউকে বলে না, সে যতই কাছের বান্ধবী হোক।
কিছুদিন পর সে চিন্তা করে, তার একজন কাছের বান্ধবীর সাথে ভাইয়ের প্রেম করিয়ে দিবে। এক বান্ধবীর নাম্বার তাই ফাহিম কে দিয়ে বললো- ভাইয়া, এই নাম্বারে কথা বল। এটাই হবে আমার ভাবী। ফাহিম জানতে চায়, নাম কী মেয়েটার? কোন ক্লাসে পড়ে? বাসা কোথায়?
কিন্তু রোজা কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন করে সব জেনে নিতে বলে।
দু’দিন পার হয়ে যায়। ফাহিম ব্যস্ততার কারণে ফোন করতে পারেনি। রোজা আবার জিঙ্গেস করে ফোন দিয়েছিলো কিনা। যখন জানতে পারে ফোন করেনি তখন সে মেয়েটার সম্পর্কে একটু বলে ফেলে। যেমন, মেয়েটার নাম- শারিকা। রোজার খুব কাছের বান্ধবী। পাশের গ্রামেই তাদের বাসা। তার কোনো ভাই-বোন নেই। সে আগে একটা প্রেম করেছিলো কিন্তু ব্রেকআপ হয়ে গেছে।
সব কিছু শুনে ফাহিম একটি মেছেজ করে- হায়।
কিচুক্ষণ পর শারিকার উত্তর আসে-হ্যালো।
-‘তুমি নাকি রোজার ভাবী?’
-‘কে বললো? আমার তো বিয়েই হয়নি! আর আপনি কে?’
-‘আমি ফাহিম, রোজার ভাই। রোজা বলেছে তুমি ওর ভাবী।’
-‘না ভাইয়া আমার বিয়ে হয়নি। ও আমার বান্ধবী।’
-‘ওহ! আচ্ছা। আমি তোমার বন্ধু হতে পারি?’
-‘নাহ।
-‘কেনো? আমি তো তোমাকে প্রেমের প্রস্তাব করে বসছি না! তাই না?’
-‘বন্ধু হয়ে কী হবে! আর আমি তো প্রেম করি, ভাইয়া।’
-‘ওহ আচ্ছা। তা তোমার বয়ফ্রেন্ডের নাম কী? কী করে?
-‘জয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আসলে ভাইয়া আমি প্রেম করি এটা রোজা জানে না। ওকে বলা হয়ে ওঠেনি।’
-‘বলোনি কেনো? তোমার নাকি কাছের বান্ধবী।’
-‘বলতে পারিনি। এখন বলবো ভাবছি। কিন্তু কিযে ভাববে!’
-‘ওহ, বলিও। কী আর ভাববে! নিজস্ব বিষয় বলতে নাইবা পারো। এতে ভাবার কী আছে?’
-না, আমি তো বলবো।
-‘হুমম, বলিও এখন। সমস্যা কী?
-‘হুমম। ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি অনেক ভালো।’
-কীভাবে বুঝলে?
-‘রোজা মাঝে-মাঝেই আপনার প্রশংসা করে।’
-‘ওহ। ঠিক আছে। ভালো থেকো।
-ওকে ভাইয়া। আপনিও ভালো থাকবেন।
বিষয়টাকে ফাহিম স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলো। কারণ সে তো বরাবরই প্রেমিকাহীন ব্যাচেলর। একলা থাকাই তার নিত্য প্রয়োজনীয় ডাল-ভাতের মতো।
জীবন নদী, জোয়ার বিহীন, ভাটা পড়ে আটা-আটা। কোথায় ফাহিম ভেবেছিলো এবার একটা প্রেম হবে, কিন্তু না। হলো না।
সে অতি স্বাভাবিক নম্রভাবেই রোজাকে বললো, তোমার বান্ধবী তো প্রেম করে।
রোজা তখন প্রতিক্রিয়া দেয়- কী! অয় প্রেম করে অথচ আমি জানি না! এই কথাটা অয় আমাকে বলতে পারেনি! অর সাথে আর কথাই বলবো না।
-‘না-না, কী বলছিস এসব! বলতে পারেনি কিন্তু দেখা হলে বলবে বলেছে।
-‘অর সাথে আর কথাই বলবো না। দেখা হোক খালি, অক যে কী করবো!
-‘কথা বলবি না কেন! ও তো কোনো অপরাধ করেনি। তোর কাছের বান্ববী। আর তুই কী তোর সব পার্সনাল কথা সবাইকে বলিস!’
রোজা একটু বুঝতে পারে। সব কথা তো সবসময় সবাইকে বলা যায় না। সে একটু ঠাণ্ডা মাথায় বলে- সরি ভাইয়া। আমার আসলে ওর সম্পর্কে ভালোভাবে জানা উচিৎ ছিলো।
-‘আরে না। ঠিক আছে বোন, সমস্যা নেই। তুই আবার একটি মেয়ে খুঁজবি।
-‘ওকে ভাইয়া। এবার ভালোভাবে জেনে তারপর বলবো।
-‘হুমম।
এরপর ফাহিম নিজেও প্রেম করার চেষ্টা করে তিন-তিনবার ব্যর্থ হয়। তারপর তারই কলেজের একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়। মেয়েটি যেমন সুন্দরী, তেমনি লম্বা-চওড়া নাদুসনুদুস। ভালো ছাত্রী উইথ সহশিক্ষা। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে মেয়েটি তার বড়। সে অনার্স ১ম বর্ষে পড়ে। সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার নাম- মোছাঃ মিম আশরাফি। সম্পর্ক হওয়ার পর থেকে ফাহিম তাকে মিম বলেই ডাকতো।
প্রেম যখন হলো, জীবন ফেরালো
ছায়ার মতো সে কাছেতে রলো।
মুক্ত-স্বাধীন পাখিদের মতো-
রাত-বিরাতে কত কথাও হতো।
দেখাও হতো, খাওয়াও হতো
বিরিয়ানী- ফুসকা- আইসক্রীম,
ঘোরাও হতো, জোড়াও হতো
সিনেমা হল- পার্কে, নাইসড্রিম।
জান বলে ডাকতো মিম আর করতো কতশত বায়না। আজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাও তো কাল শপিং করতে নিয়ে যাও, পর্শু চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাও, টর্শু রিকশায় ঘুরতে যাও। এমন সব বায়নাই ফাহিম পূরণ করতো। আনন্দ পেতো মেয়েটির পাগলামী দেখে। অনেক সাধনার পরে পাওয়া একটি প্রেমিকা, সে কখনো ভাবতো না এই মেয়েটি তাকে ছেড়ে যাবে।
একদিন মিম বললো- জান, চলো আজকে ঘুরতে যাই।
ফাহিম সাথে সাথেই রাজি। তাকে নিয়ে গেলো রাজবাড়ী, ঘাঘট নদী, চিতলীর বিল। কতশত কথা হলো, সেল্ফি হলো, নৌকায় চড়া হলো। দারুন মুহুর্ত কাটলো।
কারণ বসতো এক ফাঁকে মিম বললো- আমার ফোনটা নষ্ট হয়েগেছে, ঠিক করা লাগবে।
ফাহিম বললো- কই দেখি?
-‘ব্যাগে আছে। থাক ঠিক করবো কয়েদিন পর।
-‘তুমি আমার ফোনটি নাও। আর তোমারটা দাও, ঠিক করে দেবো।
-‘তুমি কী দিয়ে চলবে?
-‘আরেকটা কিনবো।
-‘আচ্ছা, দাও।
ফাহিম দিলো তার পনেরো হাজার টাকার ফোনটা। কিন্তু ফোনের চার্জার পিন আলাদা তাই মিম চার্জার পাবে কোথায়? সেই প্রশ্ন করলো। তখন ফেরার পথে দোকান থেকে একটি চার্জারও কিনে দিলো ফাহিম। তারপর সেদিনের মতো বিদায় নেয়ার সময় সে মিমের নষ্ট ফোনটা চাইলো। কিন্তু সে বললো- থাক, নষ্ট ফোন দিয়ে কি করবা!
এভাবে দু’দিকে দুই জোড়া প্রেমিকের প্রেম চলছিলো টানা এক বছর। একদিকে ফাহিম ও মিম। অন্যদিকে ফাহিমের বোন; রোজা ও জনি। যদিও ফাহিম বড়ো কিন্তু পারিবারিক একটা রীতি আছে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া। সেই রীতি সত্য করে ফাহিমের আগে রোজার বিয়ে ঠিক হয়ে যায় জনির পরিবারের প্রস্তাবে।
বোনের বিয়েতে মিমকেও দাওয়াত করে ফাহিম। বেশ ধুমধাম করে একটি যুগলের বিয়ের মাধ্যমে ভালোবাসার পূর্ণতা পায়।
বিদায় বেলায় কান্নার সুরে রোজা ভাইয়ের কাছে একটাই কথা ব্যক্ত করে- ভাইয়া তোকে লাল টুকটুকে বউ খুঁজে দিতে পারলাম না। তুই খুঁজে নিস।
ফাহিম সান্ত্বনা দিয়ে বলে- তুই সুখী হও বোন। আমি তোর আশা পূরণ করবো; তোর একটা মিষ্টি ভাবি এনে দেবো।
রোজার বিয়ের মাস চারেক যেতে না যেতেই মিমেরও বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু তা ফাহিমের সাথে নয়। একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক অফিসারের সাথে। সেই বিয়েতে মিম নিজেই রাজি।
ফাহিম প্রশ্ন করে- তাহলে আমাদের এতো দিনের সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই?
-‘থাকবে না কেন? এতদিনে তুমি-আমি কত মজা করেছি। প্রেম করে একসাথে কত সময় কাটিয়েছি। আর কী মূল্য চাও?
-‘তার মানে তুমি প্রেম করেছো শুধু মজা করে সময় পার করার জন্য, বিয়ের জন্য নয়!
-‘অবশ্যই। তোমাকে বিয়ে করবো? কী আছে তোমার! আমি তোমার সাথে ঘুরেছি, প্রেম করেছি এটাই বেশি। তুমি ছোট জেনেও প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলাম শুধু একটু উপভোগ করার জন্য আর তোমাকে ভাঙ্গিয়ে খাওয়ার জন্য। আমি তো জানি তুমি দু’তিন ক্লাস এগোতে এগোতেই আমার কোনো প্রতিষ্ঠিত ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যাবে। তাই হলো, একজন ব্যাংকারের সাথে আমার বিয়ে। দাওয়াত খেতে আসিও।
ফাহিম বুঝতে পারে, এ কোনো প্রেম ছিলো না; সাময়িক বিনোদন, ধোকা। যে ধোকায় খরচ করতে করতে ফাহিম দেউলিয়া। বই কিনে নাকি কেউ দেউলিয়া হয় না। কিন্তু ফাহিম বই না কিনেও দেউলিয়া হয়েছে। কী না করেছে মেয়েটার জন্য। যখন যা আবদার করেছে সব আবদার মিটিয়েছে। সত্যি সত্যি অনেক ভালোবেসে ফেলেছে মেয়েটাকে। কোনো দিন কল্পনা করতে পারেনি মিম তার ভালোবাসা মিথ্যে প্রমাণ করে তাকে ছেড়ে সে চলে যাবে।
সেই মিম বিয়ে করে চলে গেলো, রেখে গেলো স্মৃতি। যে স্মৃতি মনে করে-করে ফাহিমের দিন-রাত্রির ঘুম হারাম। আরমান আলিফের গান শুনতে শুনতে আর নেশায় আসক্ত হয়ে পাগল প্রায়।
সে তার বোনকে আর বলতে পারে না, তুই আমার কলিজার টুকরা একটা বোন; আমি তোর মিষ্টি একটা ভাবি এনে দেবো। তাই রোজার লাল টুকটুকে একটা ভাবি পাওয়ার আশাও চিরজীবনের জন্য অপূর্ণ রয়ে গেলো।
এখন শুধু ফাহিম রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় আর অসম বয়সি প্রেমিকযুগল দেখলে বলে ওঠে- বোকা-বোকা, ধোকা-ধোকা।
হাহ হাহ হা, বোকা-বোকা, ধোকা-ধোকা।
যুগলেরা কেউ বুঝে না তার কথার রহস্য কী। তারা এক নিমিষেই তার কথা উঠিয়ে দিয়ে বলে- আরে! ও তো পাগল