বৃদ্ধাশ্রম
শামীমা আক্তার
রাহেলা বেগম। বৃদ্ধা এক নারী, বিধবা এক নারী। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি একজন মা। এক সন্তানের জননী তিনি। রাহেলা বেগমের স্বামী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন তিনি। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী তিনি।
তার ছেলেটা তখন তার পেটে ছিল। তার স্বামী যখন শহীদ হন, তিনি তখন ৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। যুদ্ধের সময় অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে তিনি বেঁচে ছিলেন এবং তার পেটের সন্তানটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। একদিকে স্বামী হারানোর শোক। অন্যদিকে অন্তঃসত্ত্বা। সব মিলিয়ে সেই সময়টা তার জন্য অনেক বেশি কঠিন ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার সন্তানের জন্ম হলো। তিনি তার সন্তানের নাম রাখলেন স্বাধীন। স্বাধীন তার একমাত্র সন্তান। এই সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে তিনি একা একা কাটিয়ে দিয়েছেন তার সারাটি জীবন। রাহেলা বেগমের মা-বাবা অনেক চেষ্টা করেও রাহেলা বেগমকে আর বিয়ে দিতে পারেননি। রাহেলার এক কথা, সৎ বাবা যদি তার ছেলেকে দেখতে না পারে, তাকে অবহেলা করে, সেটা তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তাই তিনি জীবনে আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। সন্তান স্বাধীনকে নিয়ে শুরু হলো রাহেলা বেগমের জীবন যুদ্ধ। স্কুলে মাস্টারি করেছেন। সেলাইয়ের কাজ করেছেন। এভাবে অনেক কষ্ট করে ছেলের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করেছেন। মুক্তিযোদ্ধার লিস্টে তার স্বামীর নাম না থাকায় রাহেলা বেগম মুক্তিযোদ্ধা ভাতা কিংবা একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে কোনো ধরনের সহায়তা পাননি। স্বাধীন খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। ক্লাসে সব সময় ফার্স্ট হতো। এস এস, সি থেকে এম, এ পর্যন্ত সব জায়গায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে সে। তারপর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। এখন সে মস্ত বড় অফিসার! মেজিস্ট্রেট হয়েছে সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়ে সুরমা নামের এক মেয়ের সাথে তার প্রেম হয়। মাকে সেই কথা বলে স্বাধীন। বলে সুরমা ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করবে না সে। মা ছেলের খুশির জন্য সুরমাকে ঘরের বউ করে আনে। ছেলের খুশিই তার খুশি। কারণ ছেলেটাই তো তার সবকিছু। ছেলে ছাড়া তার আর কেউ নেই। বিয়ের পর স্বাধীন মস্ত বড় একটা ফ্ল্যাট কিনলো৷ সেখানে তার বউ ও মাকে নিয়ে উঠলো। সেখানে কিছুদিন রাহেলা বেগমের ভালোই কাটলো। তারপর থেকে সুরমা, রাহেলা বেগমকে সহ্য করতে পারছিল না। তাকে বোঝা মনে করছিল। একদিন সুরমা স্বাধীনকে বলল, দেখো, তোমার মায়ের এখানে থাকাটা আমার পছন্দ নয়। আমার ভাল লাগেনা তাকে। একটা উটকো ঝামেলা। এই ফ্ল্যাটে হয় তিনি থাকবেন, না হয় আমি থাকবো৷ আমি তার সাথে এক ফ্ল্যাটে থাকতে পারবো না। সুরমার মুখে এই কথা শুনে স্বাধীন খুব অবাক হলো এবং বলল, এসব কি বলছ তুমি সুরমা! মা এখানে থাকলে সমস্যা কি? আমরা তিনটাই তো মানুষ। সবাই মিলেমিশে এখানে থাকবো। তাছাড়া মা বৃদ্ধ মানুষ। আমি ছাড়া মায়ের আর কোনো সন্তান নেই। মা কার কাছে যাবেন? কোথায় যাবেন? তখন সুরমা বলল, কেন? বৃদ্ধ মানুষদের থাকার জন্য বৃদ্ধাশ্রম আছে। তুমি তোমার মাকে সেখানে রেখে আসো। সেখানে অন্য আরো অনেক বৃদ্ধ মানুষ থাকে। তাদের সাথে ভালোই থাকবেন তিনি। স্বাধীন বলল, না, মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে পারবো না আমি। তখন সুরমা বলল ঠিক আছে, তুমি তোমার মাকে নিয়ে থাকো, আমি আমার বাবার বাড়ি চলে যাচ্ছি। আর কোনোদিন ফিরবো না। সময়মতো ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে দিব। এই কথা বলে সুরমা কাঁদতে কাঁদতে তার ব্যাগ গুছাতে লাগলো। স্বাধীন তখন সুরমাকে হাতজোড় করে বলল, প্লিজ তুমি এমন করো না। ঠিক আছে আমি মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবো৷ তবুও তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেওনা। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
পরদিন স্বাধীন তার মাকে বলল, মা, তোমাকে আজ আমি এক জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবো। খুব সুন্দর জায়গা। রাহেলা বেগম বলল, আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি বাবা? স্বাধীন তখন বলল, একটা বাড়িতে। তোমার মতো আরো অনেক মানুষ সেখানে থাকে। তুমি কথা বলার অনেক সাথী পাবে। তাদের সাথে ভাল সময় কাটবে তোমার। তুমি যাবে সেখানে মা? রাহেলা বেগম খুব সহজ সরল মানুষ ছিলেন। তিনি বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে জানতেন না। তিনি ছেলের কথায় রাজি হয়ে গেলেন। স্বাধীন বলল মা, তুমি তোমার সব কাপড়চোপড় ও জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নাও। রাহেলা বেগম তার সমস্ত কাপড় ও জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নিলেন। তারপর ছেলের সাথে বেরিয়ে পড়লেন। তারা বৃদ্ধাশ্রমে এসে পৌছালো। রাহেলা বেগম তার ছেলে স্বাধীনকে বলল, এখানে কতদিন থাকবো বাবা? আমাকে কবে নিতে আসবি? স্বাধীন তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার সময় বলল, মা, তুমি কিছুদিন এখানে থাকো, আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাবো। এই কথা বলে চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না স্বাধীন। সে চোখের জল গোপন করলো তার মায়ের কাছে। দ্রুতগতিতে সেখান থেকে চলে এলো সে। এরপর দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, বছর যায়, রাহেলা বেগম বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন আর একদৃষ্টিতে পথের দিকে চেয়ে থাকেন, তার খোকা যে বলে গেছে তাকে নিতে আসবে। কিন্তু তার খোকা যে আর আসেনা৷ তার এই অনন্তকালের পথ চাওয়া কি শেষ হবে কোনোদিন?
হ্যাঁ, শেষ হবে একদিন।
তার এই পথ চাওয়া শেষ হবে তার অনন্তকালের যাত্রায়।