গেমস ভিলেজ বাংলাদেশ!
শেখ শাহিন ( শিক্ষক, অক্সফোর্ড পিপলস স্কুল, সাভার)।
পড়াশোনা ছিকেয় উঠেছে, গেমসে আসক্ত হয়ে ছাত্র- ছাত্রীরা তাদের সোনালি দিনগুলো দুমড়ে মুচড়ে ছিড়ে ফেলছে। অনলাইনে ক্লাসের নামে সে-ই যে ভিডিও মোবাইল ফোন হাতে নিল।কোথায় অনলাইন ক্লাস? পাড়ায়, মহল্লার, বাসার কার্নিসে বসে দল বেধে গেমস খেলছে।ঘুম জাগা পাখির মতো রাত পার করে দেয়।
বর্তমানে সারা বিশ্বে বহুল আলোচিত সমালোচিত অনলাইন গেমগুলোর মধ্যে রয়েছে পাবজি এবং ফ্রি ফায়ার অন্যতম। এই গেম গুলো আজ তরুণ ছাত্র সমাজকে মারাত্মকভাবে আকৃষ্ট করে তুলছে, তাইতো তরুণ-তরুণীরা বেশি করে ঝুঁকে পড়ছে এসব অনলাইন গেমে। ইতোমধ্যেই অনলাইন গেম মানসিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মাদকাসক্তির মতো অনলাইন গেম খেলাতেও আসক্ত হয়ে পড়ছে অধিকাংশ তরুণ-তরুণী। যার কারণে কেউ চাইলেও সহজেই গেমটি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। এখন দেখা যাচ্ছে সমাজের তরুণ-তরুণীদের জন্য অনলাইন গেম হুমকি স্বরূপ। কিন্তু বর্তমানে ইন্টারনেট বা গেম খেলা কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নয়। কিন্তু এর ক্ষতিকর, অযৌক্তিক, অপরিমিত ব্যবহারের ফলে তরুণ সমাজ ধ্বংসের মুখে। গেম খেলার বিষয়টি যখন তার চিন্তা আর আচরণের ওপর খারাপ ধরনের প্রভাব ফেলবে, সামাজিক দক্ষতা কমিয়ে দেবে বা দৈনন্দিন জীবনযাপনের মান খারাপ করে দেবে তখন তা আসক্তির পর্যায়ে চলে যায়। এই বিষয়ে সচেতনতা জরুরি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লম্বা ছুটিতে শিক্ষার্থীরা অবসর সময় কাটানোর জন্য অনলাইন গেমকে বেছে নিয়েছে। করোনার প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে আমি যখন গ্রামে বাড়ি ছিলাম তখনই স্কুল ও কলেজের ছাত্রেদের অনলাইন গেমে আসক্তির চিত্রটি লক্ষ করি। আগে যারা বিকেল হলেই বল ও ব্যাট নিয়ে মাঠে যেত ক্রিকেট খেলতে। এখন তারা হাতে মোবাইল নিয়ে মাঠের কোন এক কোণে বসে পাবজি কিংবা ফ্রী ফায়ার গেম খেলায় ব্যস্ত। অবিভাবকদের অসচেতনতায় আজ অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থীরাও ব্যবহার করছে এন্ড্রয়েড ডিভাইস। হাতে এন্ড্রয়েড ডিভাইস পেয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরাই অনলাইন গেমে আসক্ত হচ্ছে। তাদের গেম খেলা দেখে ১০-১২ বছেরর শিশুরাও এই গেম খেলবে এরকম ইচ্ছা পোষণ করছে। আমার ছোট ভাই ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ে, সে আমাকে একদিন বললো ভাইয়া আপনি পাবজি গেম খেলেন? আমি বললাম না। ছোট ভাই বললো ভাইয়া আপনি ফোনে গেমটা চালু করেন, আমি শুধু একদিন খেলবো তারপর আপনি গেম ডিলিট করে দিয়েন। আসলে এই পাবজি গেম খেলার প্রতি আগ্রহ কিভাবে আসলো। দেখেছি যারা পাবজি কিংবা ফ্রী-ফায়ার গেম খেলে তারা একা বসে খেলে এমনটা নয়। গেম খেলার সময় যাদের মোবাইল নেই তারা তাদের পাশে বসে গেম খেলা দেখে। আমার গ্রামে এমনও দেখেছি যে, এক ব্যাক্তি গেম খেলছে অথচ তার পাশে রয়েছে ৭-১০ জন খেলা দেখার জন্য। যারা গেম খেলা দেখার জন্য পাশে বসে রয়েছে তারা অধিকাংশই ৮-১২ বছরের শিশু। ছোট থেকে বড় সবাই আজ পাবজির এবং ফ্রি ফায়ারের সাথে পরিচিত। গ্রামের শিক্ষার্থীরাও আজ অনলাইন গেমে আসক্ত হচ্ছে। অনলাইন গেমে আসক্তির কারণে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। আসক্তির কারণে তাদের ঘুম, খাওয়া-দাওয়া, সামাজিক মেলামেশা এবং শিক্ষার ওপর প্রভাব পরছে। গেমিংয়ে থাকা অবস্থায় ওই মূহুর্তে আশপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিষয়বস্তুতে মনোনিবেশ ও কর্ণপাত করতে পারছে না। অভিভাবকের সচেতন হতে হবে। আপনি আপনার সন্তানের হাতে যে স্মার্ট ডিভাইসটি তুলে দিচ্ছেন, সেটি আপনার সন্তান কোন কাজে ব্যাবহার করছে সে বিষয়ে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, এই ডিজিটাল অনলাইন ভিডিও গেম সব বয়সের ব্যবহারকারীর জন্য নয়। আপনার সন্তান কোন গেমিং অ্যাপ ডাউনলোড করছে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। অভিভাবক হিসেবে গেমিং অ্যাপ ডাউনলোডের ক্ষেত্রে নিজেরও সচেতন থাকা জরুরি।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, পাবজি: হচ্ছে একটি অনলাইন মাল্টিপ্লেয়ার ব্যাটল রয়্যাল যা নির্মিত এটি প্রকাশিত হয়েছে পিইউবিজি কর্পোরেশন কতৃর্ক, এটি দক্ষিণ কোরিয়ার ভিডিও গেম কোম্পানি ব্লুহোলের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। ২০১৬ মার্চ মাসে গেমটি স্টিম এর আগাম অ্যাক্সেস বিটা প্রোগ্রামের মাধ্যমে মাইক্রোসফট উইন্ডোজের জন্য রিলিজ করা হয়, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬-এ গেমটি সম্পূর্ণ রিলিজ হয়।
ফ্রি ফায়ার: একটি ব্যাটল রয়্যাল গেম যা ১১১ ডটস স্টুডিও দ্বারা বিকাশিত এবং অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএসের জন্য গেরিনা দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে। গেমটি রিলিজ হয় সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে। ২০১৯ সালে এটি বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক ডাউনলোড করা মোবাইল গেম হয়ে উঠেছে। জনপ্রিয়তার কারণে, গেমটি ২০১৯ সালে গুগল প্লে স্টোর দ্বারা “সেরা জনপ্রিয় ভোট গেম” এর জন্য পুরস্কার পেয়েছিল।
গেমগুলো এমন আনন্দদায়ক এবং অত্যাধুনিক ভাবে তৈরি করছে যা ব্যবহারকারীরা প্রতিনিয়তই গেমের প্রতি আরো আকৃষ্ট হচ্ছে। দেশে প্রতিদিন বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ২০২০ সালের হিসাবে, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সংখ্যা ১১ কোটি ছাড়িয়েছে।
আমাদের দেশে অনেক পরিবারে বাবা-মা দুজনই কর্মব্যস্ত। উভয়েই ছুটছেন ‘ক্যারিয়ার ও সফলতা’ নামক সোনার হরিণের পিছনে। এদিকে সন্তান বড় হচ্ছে কাজের বুয়ার কাছে। মায়ের অবর্তমানে সন্তান যার কাছে বড় হচ্ছে সেই শিশুর খাবার খাওয়াতে, তার কান্না থামাতে- টিভি, কম্পিউটার ও ভিডিও গেমসের অভ্যাস করাচ্ছেন। এমনকি শহরের ইট, পাথরের আড়ালে আটকা পড়ছে শিশুদের দুরন্ত শৈশব। গ্রামের শিশুরা খেলাধুলার কিছুটা সুযোগ পেলেও শহরের শিশুদের সে সুযোগ কম। বড়দের মতো শিশুদের মধ্যেও ভর করছে শহুরে যান্ত্রিকতা। ফলে তারা খেলাধুলার আনন্দ খুঁজে পেয়েছে মোবাইল ফোনে, মাউসের বাটন টিপে, কম্পিউটারের পর্দায় গেমস খেলে। অনেক সময় তাদের এ আকর্ষণটা চলে যাচ্ছে আসক্তির পর্যায়ে। তাই বলা যায়, ভিডিও গেমস আমাদের শিশু-কিশোরদের প্রকৃত শৈশব-কৈশোর কেড়ে নিচ্ছে। আর দেশের তরুণ সমাজ তো আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে। মাদকাসক্তির মতো যারা একবার গেমে জড়িয়েছে, এই জীবন ধ্বংসের ফাঁদ থেকে ফিরতে পারছে না। আমরা এই গেমের ক্ষতিকর, অযৌক্তিক, অপরিমিত ব্যবহার না করি সে বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।
কিছু করার নেই দেশ আমার ডিজিটাল।
Thanks brother