সিলেটের জকিগঞ্জের অমলশিদ এলাকায় বরাক মোহনায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উৎসস্থলের একটি ডাইক (নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ) ভেঙে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। গতকাল শুক্রবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে তীব্র পাহাড়ি ঢলের ধাক্কায় ডাইকের কমপক্ষে ৬০ ফুট অংশ ভেঙে গেছে। এর আগে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে এ ভাঙনের ঘটনায় সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের তীব্র স্রোতে ভারতের সীমান্তবর্তী বরাক নদের মোহনায় ডাইকটি ভেঙে গেছে। এরপর মুহূর্তেই জকিগঞ্জ উপজেলার ফিল্লাকান্দি, অমলশিদ, বারঠাকুরী, খাসিরচক, খাইরচক, বারোঘাট্টা, সোনাসারসহ বেশ কিছু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। একই সাথে উপজেলা সদরের সাথে অমলশিদ যাতায়াতের রাস্তাটিও পানিতে ডুবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে এই রাস্তা দিয়ে যান চলাচল বন্ধ আছে।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, সিলেট থেকে প্রায় ৯২ কিলোমিটার দূরে জকিগঞ্জের অবস্থান। এটি জেলার সবচেয়ে দূরবর্তী উপজেলা। ভারতের করিমগঞ্জ জেলার বরাক নদের দু’টি শাখা হচ্ছে সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী। এর মিলনস্থল হচ্ছে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অমলশিদ এলাকা। এই অমলশিদে একটি ডাইক আছে। বরাক থেকে পানি এসে প্রথমে সরাসরি এ ডাইকে আঘাত করে। এরপর পানি ভাগ হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারায় প্রবাহিত হয়।
সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর মাধ্যমেই মূলত সিলেট বিভাগের প্রায় ১০০টি নদ-নদীতে পানি প্রবাহিত হয়। এখন ডাইক ভেঙে যাওয়ায় পানি কোনো বাধা না পেয়ে তীব্র গতিতে সরাসরি সুরমা ও কুশিয়ারায় গিয়ে ঢুকছে। ফলে পুরো সিলেট জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
জকিগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পল্লব হোম দাস বলেন, ডাইকটি ভেঙে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। এতে নতুন করে উপজেলার কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ ডাইক ভেঙে যাওয়ায় সিলেটের অন্যান্য উপজেলায়ও পানি বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে।
এ দিকে প্রায় ১৫ দিন ধরে টানা বৃদ্ধির পর অবশেষে ভাটার টান পড়েছে সুরমার পানিতে। শুক্রবার থেকে সিলেটের এই প্রধান নদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করে। তবে এখনো প্রতিটি পয়েন্টেই বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
শুক্রবার বিকেল ৪টায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হিসাবে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ৯৬ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাউবোর হিসাবে শুক্রবার কানাইঘাট পয়েন্টে ভোর ৬টায় ১৩.৭৫ মিটার, সকাল ৯টায় ১৩.৭০ মিটার এবং বিকেল ৪টায় ১৩.৬৯ মিটার দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এই পয়েন্টের বিপদসীমা ১২.৭৫ মিটার। অপর দিকে সিলেট পয়েন্টে সকাল ৬টায় ১১.২০ মিটার, সকাল ৯টায় ১১.১৮ মিটার ও বেলা ৪টায় ১১.১২ মিটার দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এই পয়েন্টে বিপদসীমা ১০.৮০ মিটার। পাউবোর হিসাবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার বেলা ৪টা পর্যন্ত সুরমার পানি কানাইঘাটে ১২ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে প্রায় ১৬ সেন্টিমিটার পানি কমেছে।
অপর দিকে কুশিয়ারা নদীর পানি অমলশিদে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৮ সেন্টিমিটার কমেছে। তবে এই সময়ে ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার বেড়েছে। এ ছাড়া কিছুটা কমেছে লোভা, সারি, ধলাই, নদীর পানিও।
জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জেলার ১৩টি উপজেলার ১০টিতে ৭০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছিল। গতকাল নতুন করে আরো ১৬টি যোগ হয়ে বন্যাকবলিত ইউনিয়নের সংখ্যা বেড়ে হলো ৮৬টি। সিলেট জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার আহসানুল আলম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, সিলেট জেলায় এক হাজার ৪২১ হেক্টর আউশ ধানের বীজতলা এবং বোরো ফসলের এক হাজার ৭০৪ হেক্টর এবং গ্রীষ্মকালীন সবজির এক হাজার ৩৩৪ হেক্টর জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার পুকুর ও জলাশয় প্লাবিত হয়ে প্রচুর পরিমাণ মাছ ভেসে গেছে। এ ছাড়া প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ মাদরাসাসহ ৬৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যা কবলিত হয়েছে। বন্যাকবলিত অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। পানিবন্দী লোকজনের আশ্রয়ের জন্য সিলেট জেলায় ৩২৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বর্তমানে ৯৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে সাত হাজার ৩৪৯ জন আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ২৩৮টি গবাদিপশু আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
জেলা প্রশাসন জানায়, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য সিলেট মহানগর ও উপজেলাগুলোতে ১৩ লাখ টাকা, ২৩৪ টন চাল, তিন হাজার ৯৯ প্যাকেট শুকনো খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকা ও আশ্রয়কেন্দ্রে স্বাস্থ্যসেবা এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ওষুধ, খাবার স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হচ্ছে। এর আগে বুধবার পর্যন্ত পানিবন্দী লোকজনের আশ্রয়ের জন্য সিলেট জেলায় ২৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হলেও এক দিনের ব্যবধানে আশ্রয়কেন্দ্র বৃদ্ধি করা হয়েছে। ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ছয় হাজার ৪৭৫ জন আশ্রয় গ্রহণ করলেও তা এখন সাত হাজার ছাড়িয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সকালে জেলা প্রশাসক কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় এবং বিকেলে বিশ্বনাথ উপজেলার বন্যা উপদ্রুত এলাকা এবং আশ্রয়কেন্দ্রে পরিদর্শন শেষে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন।
ছাতকে বন্যায় বেড়েছে দুর্ভোগ
ছাতক (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, সুনামগঞ্জের ছাতকে বন্যায় বেড়েছে মানুষের দুর্ভোগ। উপজেলার প্রতিটি গ্রামের বসতবাড়িগুলোতে প্রবেশ করেছে পানি। রাস্তাঘাট ব্রিজ কালভার্ট পানির নিচে। সব এলাকা এখন বন্যায় প্লাবিত। এ পর্যন্ত উপজেলার প্রায় লাখো মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। পানি বৃদ্ধির কারণে এখন সারা দেশের সাথে ছাতকের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
বন্যার পানিতে পৌর এলাকার বাঁশখলা, চরেরবন্দ, মণ্ডলীভোগ, দক্ষিণ বাগবাড়ী, ভাজনামহলসহ বেশির ভাগ অলিগলিতে পানি ঢুকে পড়ায় পরিবার নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব এলাকার লোকজন। গতকাল শুক্রবার দুপুর ২টা পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৯.০৫ সেন্টিমিটর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
দোকান ও মার্কেটের সামনে বন্যার পানি থাকায় বন্ধ রয়েছে বেশির ভাগ দোকানপাট। বন্যা দুর্গতদের জন্য পাঁচটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। দুর্গতদের জন্য দিনভর দুই শতাধিক পরিবারকে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় লোকজনের তুলনায় সরকারি ত্রাণ অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।