বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে ঝিনাইদহের শৈলকুপায়।
একযুগে একশো একুশ খুন
প্রাণ-প্রকৃতির আধার নৈসর্গিক জনপদ শৈলকুপা। কুমার-গড়াই নদীবিধৌত ঝিনাইদহের এ উপজেলাটি দেশের অন্য আট-দশটি উপজেলা থেকে ব্যতিক্রম। তুচ্ছতাচ্ছিল্য বিষয়ে এখানে ঘটে মারামারি, হত্যাকাণ্ড। এখানে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড মামুলি বিষয়। তিন মেয়াদের ক্ষমতায় এ উপজেলায় প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। সংখ্যাটা আঁতকে ওঠার মতো। সব মিলিয়ে খুনের সংখ্যা প্রায় ১২১। শৈলকুপার পাড়া-মহল্লায় কান পাতলেই শোনা যায় বাবাহারা সন্তান, স্বামীহারা স্ত্রী আর সন্তানহারা মায়েদের কান্না। এসব হারানোর মিছিলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক মামলা। প্রকৃত দোষীদের বাদ দিয়ে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডেই আসামি করা হয় অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে। ভাঙচুর, ঘরবাড়ি লুটপাট এখানে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। হত্যাকাণ্ডের পরে প্রভাবশালী একটি পক্ষ চালায় লুটপাট। সম্পদে ফুলেফেঁপে তারা হয়েছে মহাপরাক্রমশালী। তাদের এই রোষের শিকার হয়ে পথে বসেছে অসংখ্য পরিবার। কেউ কেউ সন্তান-সন্ততি নিয়ে চিরতরে ছেড়েছেন এলাকা। অনেকেই এলাকা ছাড়ার চিন্তাভাবনা করছেন।
গত এক যুগে ঘটা এসব হত্যাকাণ্ডের মাত্র দুটির বিচার হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হত্যার শিকার হওয়া মানুষের পরিবারগুলো হয়েছে এলাকাছাড়া। স্কুল-কলেজ ছেড়ে পিতাহারা সন্তানরা নেমেছেন সংসার টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে। অন্যদিকে হত্যাকারীরা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বাড়িয়ে চলেছেন অপরাধের সাম্রাজ্য। বিচারের বাণী যেন নীরবে নিভৃতে কাঁদছে শৈলকুপায়। বছরের পর বছর ধরে এমন অরাজকতা চলে এলেও নির্বিকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। দলীয় কোন্দল মেটানোর দায়িত্ব স্থানীয় সংসদ সদস্যের হলেও তিনি করছেন উল্টো। একটি পক্ষকে উসকে দিয়ে বিচারে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি করছেন। কখনো কখনো ভুক্তভোগীদের করছেন এলাকাছাড়া। প্রশাসন শক্ত ভূমিকা পালন শুরু করলে তাদেরও বদলি করার তোড়জোড় শুরু করেন সেসব প্রভাবশালী। ফলে যারাই শক্ত ভূমিকা নিয়েছেন, তাদের অল্প দিনের মাথায় বদলি করা হয়েছে।
সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শৈলকুপার সারুটিয়া ইউনিয়নে প্রাণ হারিয়েছেন নারীসহ ৭ জন। নিহতের প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী। নিহতেরা হলেন—আব্দুর রহিম, হারান বিশ্বাস, অখিল সরকার, স্বপন মণ্ডল, জসিম বিশ্বাস, সুফিয়া খাতুন, জানেক শেখ। স্থানীয়দের ক্ষোভ, মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যবধানে সারুটিয়ায় সাতটি তরতাজা প্রাণ নাই হয়ে গেল। অথচ এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের তোড়জোড় নেই। কোনো আলোচনাও নেই। স্থানীয় এমপি কখনো এসব পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে আসেননি।
শৈলকুপা উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা জুলফিকার আলী কায়সার টিপু বলেন, গত তিন বছরে সারুটিয়া ইউনিয়নে আটটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় করা মামলায় ৬ শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে, যার অধিকাংশ ব্যক্তিই নিরপরাধ। এ ছাড়া এসব হত্যাকাণ্ডের পর ৫ শতাধিক বাড়িঘর ভাঙচুর হয়। বাড়িছাড়া হয় শত শত পরিবার। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো অন্তত ৫০ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো অনেক পরিবার ঘরবাড়ি ছাড়া।
এ ব্যাপারে শৈলকুপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা আরিফ রেজা মন্নু বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শৈলকুপা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্যাতিত হয়ে আসছেন। তেমনি নির্যাতিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। উপজেলাজুড়ে একের পর এক খুন হচ্ছে। আওয়ামী লীগ তিন মেয়াদে ক্ষমতায় অথচ শতাধিক নেতাকর্মী খুন হয়ে গেল। এ নিয়ে এমপি আব্দুল হাই কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। উল্টো একটি পক্ষকে সমর্থন দিয়ে দলের ত্যাগীদের এলাকাছাড়া করেন।
শৈলকুপা পৌরসভার একাধিকবার নির্বাচিত মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আশরাফুল আজম বলেন, এখানে খুনের ঘটনায় হওয়া অধিকাংশ মামলায় প্রকৃত আসামি বাদ দিয়ে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার অপকৌশল। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, গত ১৫ বছরে শৈলকুপাতে অনেকগুলো খুনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু স্থানীয় এমপি আবদুল হাই কোনোদিন এসব মামলা-হামলা, খুনখারাবি ঠেকাতে উদ্যোগী হননি।
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু কালবেলাকে বলেন, আমার মনে হয়, খুনখারাবি শৈলকুপা মানুষের মানসিক রোগ। তারা এটা ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। কারণ খুন-খারাবি হলেই তারা লুটপাট শুরু করে। সেখানে প্রশাসনকে কাজ করতে দেওয়া হয় না। আট মাসের মাথায় এক পুলিশ সুপারকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শৈলকুপায় আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী খুন হয়েছেন, সেগুলোর কোনো বিচার হয়নি। এখন রিপন হত্যা নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা চলছে। রিপন হত্যার বিচারের চেয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। শৈলকুপায় গত এক যুগে অন্তত ১২১ জন খুন হয়েছেন। এদের মধ্যে ৮৭ জনই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী কিংবা সমর্থক। স্থানীয় ভাবে দলের (আওয়ামী লীগ) মধ্যে কোন্দল এবং সামাজিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে।
বিভিন্ন মামলার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, গত এক যুগে এই উপজেলায় খুন হওয়া ১২১ জনের মধ্যে সরকারদলীয় নেতাকর্মীর সংখ্যা শতাধিক। কালবেলার হাতে আসা নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৯-১০ সালে শৈলকুপায় ১৫টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০১১ সালে ৮, ২০১২ সালে ৮, ২০১৩ সালে ৯, ২০১৪ সালে ১৭, ২০১৬ সালে ৮, ২০১৭ সালে ৭, ২০১৮ সালে ৭, ২০১৯ সালে ৫, ২০২০ সালে ৮, ২০২১ সালে ৪, ২০২২ সালে ৭ এবং চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৬ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
গত এক যুগে শৈলকুপার আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর গোলকনগর গ্রামের সাবেক ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ কর্মী আবু সাইদ বিশ্বাস হত্যা, ২০২২ সালের ৮ জানুয়ারি বগুড়া গ্রামের যুবলীগ নেতা কল্লোল হত্যা, ৫ জানুয়ারি ৬নং সারুটিয়ার কত্তিনগর গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী অখল কুমার দাশকে কুপিয়ে হত্যা, ৩১ জুলাই পুরাতন বকরা গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী জানিক শেখকে কুপিয়ে হত্যা, ১ জানুয়ারি ভাটবাড়িয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী জসিমকে কুপিয়ে হত্যা, ২০২১ সালের ২৫ জুলাই দামুকদিয়া গ্রামে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সদস্য ও যুবলীগ নেতা উকিল মৃধাকে কুপিয়ে হত্যা, ১০ নভেম্বর যুগীপাড়া গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী মিজানুর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা ও একই বছরের ১৭ এপ্রিল বসন্তপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী রতন মণ্ডলকে কুপিয়ে হত্যা, ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর ভাটবাড়িয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ ভোটার সুফিয়াকে হত্যা ও বৃত্তিপাড়া গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী মোখলেসুর রহমান পাইলটকে পিটিয়ে হত্যা, একই বছরের ১৭ ডিসেম্বর চররূপদাহ গ্রামের বারিক বিশ্বাসের ছেলে আওয়ামী লীগ কর্মী রিপনকে পিটিয়ে হত্যা, ২০১৯ সালের ৪ আগস্ট ৯নং মনোহরপুরের পাইকপাড়া গ্রামের আওয়ামী লীগ ভোটার পরিজান নেচ্ছা হত্যা, ২০১৭ সালের ২৯ জুন বড়দাহ গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী মনিরুদ্দীনকে কুপিয়ে হত্যা, ২০১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি কবিরপুর এলাকায় আওয়ামী লীগ কর্মী শাহিনকে কুপিয়ে হত্যা, ২০১৩ সালের ১১ জুলাই সাধুখালী গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী ফরেজ আলী মণ্ডল হত্যা, ২০১২ সালের ১৩ অক্টোবর চড়িয়ারবিল বাজারে মাসুদকে গুলি করে হত্যা, একই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ফুলহরি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা ইদ্রিস আলী মেম্বার হত্যা, ১৪ নং দুধসর ভাটোই বাজারে সার ডিলার আওয়ামী লীগ কর্মী আব্দুল লতিফকে হত্যা, ২০১০ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মণদিয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী আবুল হাসেমকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
যুবলীগ নেতা কল্লোল খন্দকার হত্যা মামলার বাদী মিল্টন খন্দকার বলেন, এমপি আব্দুল হাইয়ের নির্দেশে ১০ নম্বর বগুড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শিমুলের নেতৃত্বে প্রকাশ্য দিবালোকে আমার ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এমপির প্রভাবে আসামিরা জামিন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হত্যা মামলা তুলে নিতে আসামিরা চাপ দিচ্ছে। ভাই হত্যার বিচার চাওয়ায় উল্টো আমাকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। আমরা অসহায়। এই জনপদে মুখ ফুটে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, ভাই হত্যার বিচার চেয়ে এখন নিজেই মামলার আসামি হয়েছি।
মানবাধিকার কর্মী এবং সাবেক অধ্যক্ষ আমিনুর রহমান টুকু জানান, এই উপজেলার মানুষের মধ্যে সহনশীলতা কম, উগ্র মেজাজের। অতি সামান্য বিষয়ে তারা বড় ঘটনার জন্ম দেয়। এ ছাড়া এই উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ উচ্চশিক্ষিত, তেমনি প্রশাসনের উচ্চপদে কর্মরত। সরাসরি এসব কর্মকর্তার প্রভাব এলাকায় নেই। তবে তাদের পরিবার বা আত্মীয়স্বজন ওইসব কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়ে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। এটিও সংঘর্ষ সৃষ্টির পেছনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া এসবের জন্য রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্যও অনেকাংশে দায়ী। এমন পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী ও নেতাকর্মীদের সহনশীল হতে হবে। তেমনি সব ধর্মের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। সর্বোপরি পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে, যেন এই মানুষগুলো সহিংসতা ছেড়ে সাম্যের দিকে এগিয়ে আসে।
ঝিনাইদহ জেলা পুলিশ সুপার মো. আজিম-উল-আহসান কালবেলাকে বলেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক দলাদলিসহ নানা কারণে ঝামেলা হতেই পারে। এসব দ্বন্দ্বে গত সাড়ে তিন মাসে শৈলকুপায় দুটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা যারাই ঘটাক, প্রত্যেককে আইনের আওতায় নেওয়া হয়। ঝিনাইদহসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এক সময়ে চরমপন্থী সর্বহারাদের আধিপত্য ছিল। তখন নিয়মিত খুনোখুনি হতো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টানা অভিযানে এখন আর সে ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম নেই। এসব লোকজন নানাভাবে সমাজে মিশে গিয়ে কোনো ঘটনা ঘটনানোর চেষ্টা করলেও ছাড় দেওয়া হয় না।
এসব বিষয়ে স্থানীয় এমপি মো. আব্দুল হাইকে বারবার ফোন করার পাশাপাশি নানাভাবে তার বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হয়। তবে তাকে পাওয়া যায়নি।