বৃষ্টিভেজা বিষন্ন দুপুর। গুমোট পরিবেশের ধূসরতা লেপ্টে আছে হৃদয়ের অলিগলিতে। ভাবনাগুলো গতিহীন বিচ্ছিন্ন। উড়ে উড়ে খণ্ড মেঘের মাঝখানে গিয়ে গলতে থাকা বরফের ঠাণ্ডা ধোঁয়ার মতো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। রোদ প্রত্যাশী মন ক্লান্ত হয়ে তন্দ্রার কাছে আত্মসমর্পণ করছে বারবার।
আমার আব্বার প্রতিষ্ঠিত ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বসে আছি। রসুলপুর, কামরাঙ্গীরচরে। সময় যেনো যেতে চাচ্ছে না সামনের দিকে। একঘন্টাকে মনে হচ্ছে পুরো একটা দিনের মতো লম্বা। দৈনিক পত্রিকা পড়ার প্রতিও আগ্রহ বসাতে পারছি না।
ভেতরে বাইরে এরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পিয়ন এসে একটা চিঠি ধরিয়ে দিলো। হকচকিয়ে গেলাম। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কে বা কারা এর প্রাপক।
ধীরে ধীরে চিঠির মুখ খুললাম। দেখতে পেলাম দাওয়াতি কার্ড। মগবাজার কমলকুঁড়ি থেকে পাঠানো হয়েছে। ছড়াকার, গীতিকার আহমেদ কায়সার কর্তৃক পরিচালিত কমলকুঁড়ি সাহিত্য আড্ডা থেকে কয়েকজনকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। প্রখ্যাত কবি, গবেষক মহিউদ্দিন আকবর, জনপ্রিয় ছড়াকার মানসুর মুজাম্মিলসহ আরও তিন চারজনের সাথে আমিও সংবর্ধিত অতিথি। ছড়াকাগজ ঝিলিক সম্পাদক হিসেবে।
আজকের অনেক খ্যাতিমান ছড়াকার ২০০১ সালে ছিলো উদীয়মান। নাম বললাম না। কারণ, তালিকা দীর্ঘ হয়ে যাবে। ছড়াকাগজ “ঝিলিক” ছিলো তাদের আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু। এককভাবে একটি ছড়াকাগজ বের হওয়া সেসময়ের জন্য খুব সহজ কাজ ছিলো না। কবি আল হাফিজের প্রেরণায় আমার এই উদ্যোগটা ছিলো মরুর বুকে সবুজ ঘাস গজানোর মতোই।
নির্দিষ্ট দিন যথাসময়ে হাজির হলাম আড্ডা স্থলে। কবি, প্রকাশক আরিফ নজরুলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠান শুরু হলো। মডারেটর অতিথিদের একে একে মঞ্চে আহবান করলো। মানসুর মুজাম্মিলের পরই আমি গিয়ে বসলাম মহিউদ্দিন আকবরের পাশে।
প্রথম পর্বে থাকলো স্বরচিত লেখা পাঠ ও পঠিত লেখার ওপর আলোচনা। পাঠান্তে মহিউদ্দিন আকবর একগাদা লেখার ওপর আলোচনা শুরু করলেন। প্রথমবারের মতো পরিচিত হলাম মহিউদ্দিন আকবরের পাণ্ডিত্যের সাথে। কাঠখোট্টা বলিষ্ঠ আলোচনা। কাউকে ছাড় না দিয়ে কঠিন সত্য উচ্চারণে প্রতিটা লেখার ওপর চাবুক মারতে আরম্ভ করলেন। সবাই তটস্থ হয়ে গলদকরণ করছে। ভবিষ্যতে আলোকিত কাব্যিক পথে সাবলীল হাঁটার জন্য যা নিতান্তই প্রয়োজন ছিলো। জীবনের এই পর্যায়ে এসে একটু দেরীতে হলেও বুঝতে সক্ষম হয়েছি।
শুরুর দিন মহি ভাইর সাথে (তাকে আমরা মহি ভাই বলে ডাকতাম) তেমন কথা হয়নি। অনুষ্ঠানের ফাঁকে অল্প সময়ের আলাপ। ঝিলিকের প্রতি সংখ্যায় তার লেখা যত্নে ছাপা হওয়ার বিনয়ী কৃতজ্ঞতা, নরম গলায় প্রকাশ করলেন। সেইসাথে পত্রিকার ফর্মা বাড়ানোর জন্য তিনি পরামর্শ দিলেন।
সেন্টার ফর ন্যাশনাল কালচার (সি.এন.সি)’র উদ্যোগে একবার কবি হাসান আলীমের জন্মোৎসব পালন করার সিদ্ধান্ত হয়। তখন আমি ছিলাম সি.এন.সি’র বুধবারের কবিতা আড্ডার নিয়মিত মডারেটর। উদ্যোগের পেছনে বড় ভূমিকা ছিলো সেসময়ের উক্ত প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক নূরুল আমীন চৌধুরীর। অনেকটা তড়িঘড়ি করেই কাজটা করেছিলাম। নির্দিষ্ট দিন বৈকালিক প্রোগ্রামের দুপুর বেলায় হাজির হলাম মহিউদ্দিন ভাইর ওয়ারীর বাসায়। অধ্যাপক নূরুল আমীন চৌধুরী তাকে ব্যানার তৈরী করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বাসায় ঢুকে দেখলাম এখনো কাজ শেষ করতে পারেননি। প্রায় আধাঘন্টা সময় লাগলো কাজের ফিনিশিং টানতে। এই সময়ের ভেতরেই আলাপচারিতায় জানতে পারলাম নজরুলকে নিয়ে তার গবেষণার মহাসমুদ্র। মোটামোটা ভলিউম। সোনালি ফসল বদ্ধ পুকুরের মাছের মতো ডায়েরির পাতায় সীমাবদ্ধ ছিলো। জানি না পরবর্তীতে দিগন্ত আলোকিত করতে সক্ষম হয়েছিলো কি না!
একই সাথে অনেকগুলো সাহিত্য সভায় অংশগ্রহণ করেছি। চরিত্রে ছিলো অভিভাবক সুলভ আচরণ। উপস্থিতিদের লেখা পাঠ থেকে শুরু করে নাস্তা খাওয়ানো পর্যন্ত সবদিকেই সমান সতর্কতা। সত্যিই মহিউদ্দিন আকবর ছিলেন সমসাময়িক কবিদের জন্য নির্ভরযোগ্য অভিভাবক। তাঁর শূন্যতা পূরণ করতে কেউ এগিয়ে আসবেন বলে মনে হয় না। যদিও কোনোকিছু কারো জন্য অপেক্ষা করে না। তবুও কিছু শূন্যতা আজীবন অপূর্ণই থেকে যায়।
মৃত্যুর সড়কে পা রাখার চলমান রীতি পৃথিবীর একমাত্র চিরন্তন সত্য। মহিউদ্দিন আকবরের চাইতে বড় কবি হয়তো আমরা পেয়েছি বা পাবো। প্রত্যেক দশকেই দু’ একজনের প্রতিভার ঝলকানি কাব্যাকাশকে আলোড়িত করে যাচ্ছে। তথাপি জোর গলায় বলতে পারি, সদ্য প্রয়াত সাহিত্য জগতের এমন নিঃস্বার্থ নিবেদিত অভিভাবক, এমন দক্ষ সংগঠক, আগামী পঞ্চাশ বছরে মাত্র একজনও খুঁজে পাওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।