ফারুক হোসেন শিহাব
আবহমান বাংলা ও বাঙালির সাহিত্য-সৃজনে অনন্য এক নাম কবি আল মাহমুদ। সমকালীন সাহিত্যাঙ্গনে, আমাদের বাংলা সাহিত্যকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করতে, এই সাহিত্যের ভাণ্ডারকে ক্রমশ যশস্বী করার পেছনে যেসকল কবি-সাহিত্যিকদের অবদান রয়েছে কবি আল-মাহমুদ তাদের অন্যতম।
তিনি ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবনচাঞ্চল্য ও নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে অবলম্বন করে প্রচুর কবিতা রচনা করেছেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, অনুভব-অনুভূতি সহজ কথায় শতবন্ধনজালে বুনেছেন তিনি। গ্রাম বাংলার জীবন এবং মানুষের মুখের বুলির লোকজ শব্দ এবং সেই সঙ্গে ঐতিহ্য সচেতনতা তার সৃজনী জগতের মৌল বৈশিষ্ট্য। যা বাংলা সাহিত্যকে অনন্য উজ্জ্বলতা দান করেছে।
আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোয় আল মাহমুদ অত্যন্ত স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের চমৎকার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে কাব্যরসিকদের মাঝে নতুন পুলক সৃষ্টি করেন। তিনি দেশজতা, মানবিকতা, সাম্যবাদ ও এতে লগ্ন থাকার আকুতি দিয়ে পাঠকদের আকৃষ্ট করেছিলেন।
আজ প্রেমিক কবি আল মাহমুদের ৮৫তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌড়াইলের মোল্লা বাড়িতে গুণী এই কবি জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী আল মাহমুদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক ও অবিভাজ্য সত্ত্বা।
মুল আলোচিত কবি আল মাহমুদ তিন দশক ধরে আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে পরম আন্তরিকতার সঙ্গে তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়। বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক-ভঙ্গির সমন্বয়ে। বাংলা কবিতায় লোকজ ও গ্রামীণ শব্দের বুননশিল্পী কবি আল মাহমুদ নির্মাণ করেছেন এক মহিমান্বিত ঐশ্বর্যের মিনার।
কবি আল-মাহমুদ নানা কারণে একাডেমিক লেখাপড়ার বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। আমরা বলতে পারি, সমকালীন সময়ের পরিবেশ তার মানস গঠনে প্রভাব বিস্তার করে। এছাড়া তার পিতার কাপড়ের ব্যবসার বাজার পতনের দিকে গেলে পারিবারিকভাবে আর্থিক সঙ্গতি রক্ষার জন্য পিতার চাকরি পেশায় গমন এবং কবির পাঠ্যপুস্তক বা খেলাধুলার চেয়ে গল্প উপন্যাস বা সাহিত্য বিষয়ক বইয়ের প্রতি আগ্রহ ও পক্ষপাত এক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল। লালমোহন পাঠাগারের ভূমিকা তার লেখক জীবনের পশ্চাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
আল মাহমুদ কবিতায় তাঁর নিজস্ব ‘কবিভাষা’ গঠনের জন্য বাংলার আঞ্চলিক শব্দভাণ্ডারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। আমাদের বাংলার জীবন্ত ও বহমান শব্দ তরঙ্গ হতে তিনি যথেচ্ছভাবে আঞ্চলিক শব্দ গ্রহণ করে আধুনিক বাংলা ভাষার গতি-প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য সাধন করেন। আর এ সাধনায় তিনি বাংলা কবিতাকে যা কিছু দান করতে পেরেছেন তা বাংলা সাহিত্যে যে সমস্ত আঞ্চলিক শব্দের স্থায়ীত্ব দান করেছেন তাতে তিনি পরিতৃপ্ত-একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
পল্লীর উপাদান থেকে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর উপমা ও চিত্রকল্প। প্রকৃতপক্ষে তিনি কাব্যের ভাষাক্ষেত্রে এক অপূর্ব সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছেন। জসীম উদ্দীন যেখানে লোকসাহিত্যের উপাদানের ওপর তাঁর কুটির তৈরি করেন, আল মাহমুদ সেখানে আধুনিক প্রাসাদের কারুকার্যে লৌকিক উপাদানের ব্যবহার করেন। প্রেম, প্রকৃতি ও স্বদেশভূমিই ছিল তাঁর রচনার মূল বিষয়বস্তু। তাঁর সব্যসাচী লেখনীর শানিত কলম বাংলা সাহিত্যকে নতুন নতুনতর সম্পদে সমৃদ্ধ করছে।
তিনি বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে। কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল ও পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ১৮ বছর বয়স থেকে প্রকাশিত হতে থাকে তার কবিতা। সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে ১৯৫৪ সালে কবি ঢাকায় আসেন। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার মধ্যে কবি আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক কাফেলায় লেখালেখি শুরু করেন। আর কর্মজীবনের শুরু হয় দৈনিক মিল্লাতে যোগ দেয়ার মাধ্যমে। ১৯৫৫ সালে কবি আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী কাফেলার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।
আল মাহমুদ একজন সংগ্রামী কবি। তিনি জীবনকে নাড়িয়ে দেখেছেন নানাভাবে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ও কবি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল, কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ, কৃত্তিবাস ও কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত বিখ্যাত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে সুপরিচিত হয়ে ওঠে তার নাম।
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত ‘লোক লোকান্তর’, ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত ‘কালের কলস’ ও ‘সোনালি কাবিন’ কবিতাগ্রন্থ বাংলা কবিতার প্রথম সারির একজন কবি হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও বাংলা গল্পের এক আশ্চর্য সাহসী রূপকার আল মাহমুদ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত আল মাহমুদ ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিশ্বাসীদের মুখপত্র এবং সরকারবিরোধী একমাত্র রেডিক্যাল পত্রিকা ‘গণকণ্ঠ’ বের হলে তিনি এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। গণকণ্ঠ ওই সময় ব্যাপক আলোচনায় আসে।
গণকণ্ঠ পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে তিনি এক বছর কারাভোগ করেন। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহ-পরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর পরিচালক হিসেবে ১৯৯৩ সালে অবসর নেন।
বাংলা কবিতায় উজ্জ্বল অবদানের জন্য ১৯৮৬ সালে নন্দিত এ কবি কবিতায় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা থেকে কবিতার জন্য কাফেলা সাহিত্য পুরস্কার এবং ছোটগল্পের জন্য বাংলাদেশে হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
আল মাহমুদের উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ হচ্ছে- লোক লোকান্তর; কালের কলস; সোনালি কাবিন; মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো; আরব্য রজনীর রাজহাঁস; বখতিয়ারের ঘোড়া; অদৃশ্যবাদীদের রান্নাবান্না; দিনযাপন; দ্বিতীয় ভাঙ্গন; নদীর ভেতরের নদী; না কোনো শূন্যতা মানি না; ময়ূরীর মুখ; প্রেম প্রকৃতি দ্রোহ আর প্রার্থনা কবিতা এবং উড়াল কাব্য।
তার গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-পানকৌড়ির রক্ত; সৌরভের কাছে পরাজিত; গন্ধবণিক; আল মাহমুদের গল্প; গল্পসমগ্র; প্রেমের গল্প। এছাড়া তিনি উপন্যাস- কবি ও কোলাহল; কাবিলের বোন ও উপমহাদেশসহ বহু প্রবন্ধ ও শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা করেছেন। কবিতা ও সাহিত্যকর্মে যে সমাজ ও মানুষের জীবনকথা প্রকাশ পেয়েছে , তা বাংলার নিজস্ব প্রাণের প্রকাশ। লেখা লেখির সূত্রে সাহিত্যের অনেকগুলো শাখায় বিচরণ করেছেন তিনি। তবে নিজেকে একজন কবি হিসেবে পরিচয় দেয়াটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে গর্বের। একটি সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কবি হব- এটা আমার রক্তের মধ্যে ছিল। ফলে সব সময় কবিতার কথাই চিন্তা করেছি। সারাক্ষণ কবিতার ছন্দ, অন্ত্যমিল, ভঙ্গি ইত্যাদি নিয়ে ভেবেছি। এভাবেই স্বতন্ত্র পঙক্তি চলে এসেছে’।
লেখা লেখির জন্য কারাগারে পর্যন্ত গিয়েছেন বাংলা কবিতার এই প্রাণপুরুষ, তবুও থেমে যাননি। বরঞ্চ, অবিচল হয়ে ছুটেছেন দুর্বার গতিতে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘কবিতা লেখা খুব একটা সহজ কাজ নয়। একজন কবি লেখেন, এ কারণে তাঁকে পরিশ্রম করতে হয়। আমার ক্ষেত্রে কী ঘটেছে বা ঘটে? আমি আগে দেখি, তারপর লিখি। সাহিত্যে যাকে বলে কল্পনা, একজন কবি তাঁকে বহু বিস্তারিত করতে চান। আমি দেখি এবং লিখি। এই দেখা আর লেখার যে সংমিশ্রণ, সেটা অতুলনীয় এক ব্যাপার। এখানে বলে রাখি, বেশ আগে থেকেই চোখে ভালো দেখতে পাই না আমি। এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে স্মৃতিহীনতা- অনেক কিছুই আজকাল মনে করতে পারি না। ফলে খুব গুছিয়ে কথা বলা এ সময়ে আমার জন্য বেশ কষ্টকর। কিন্তু নিজের কবিতাযাপনের কথা বলতে গিয়ে বলব যে, আমি খুব ধীরেসুস্থে, চিন্তাভাবনা করে লেখা শুরু করি। লেখাটা যখন শেষ হয়, আমার মনে তখন পুলক অনুভব হয়, একটা আনন্দ জাগে। এই হলো লেখার ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা।’
কবির মুখ থেকে লেখালেখির এমন অভিজ্ঞতা শোনার আর সুযোগ হবে না আমাদের। কারণ তিনি তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন’র বর্ণনা দিয়ে চলে গেছেন পৃথিবীর সমস্ত মায়াজাল ছিঁড়ে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি (২০১৯) শুক্রবার দিবাগত রাত ১১টা ৫ মিনিটে রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে দেশবরেণ্য এই কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সশরীরে আমাদের কাছ থেকে চলে গেলেও তিনি যুগ-যুগান্তর বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মাঝে, বাঙালির সৃজনে-মননে, আগামীর পথ চলায়-অনুপ্রেরণা হয়ে। দেশের কীর্তিমান এই কবির কর্মমুখর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।