মিহির-আমার সহকর্মি
ওয়াজেদ বাঙালী
মঞ্জুরুল আলম মিহির। আমার সহকর্মি। খোকসা সরকারি কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক। গতকাল( ৩১/০৭/২০২১) রাতে(১০/৩০টায়) ঢাকা ইউনাইটেড হাসপাতলে ইন্তেকাল করেন(ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিন কিংবা চারবার টেস্ট করেও করোনা পজিটিভ নয়। অথচ করোনাই মৃত্যু হয়েছে বলে অপপ্রচার হয়েছে। একেই বলে দুঃসময়ের যন্ত্রণা। মিহির স্বাধীনচেতা ও সামাজিক একজন মানুষ ছিলেন। যেমন সাহসী ,স্পষ্টভাষী এবং প্রতিবাদি।
লোকমুখে প্রচার, কুমারখালী হাসপাতলে ,কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে তবুও করোনা চিকিৎসাই নাকি দেয়া হয়েছে। তাই প্রশ্ন জাগে, এটা কি গুজবের দেশ না মগের মুল্লুক? আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যা লেজে গোবরে অবস্থা ! ‘এটাও প্রগতি সেটাও প্রগতি’।
আজ মনে পড়ছে খোকসা কলেজে ২০০০ সালের জুলাই মাসে সেই নিয়োগ পরীক্ষার কথা। আমি ও মিহির একই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির চাকরিপ্রার্থী ছিলাম। আমি আসলাম একই উপজেলার চকহরিপুর সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে আর মিহির আসলেন বিলজানি দাখিল মাদ্রাসা থেকে।
মিহির ছিলেন যেমন সাহসী, স্পষ্টভাষী ও স্বাধীনচেতা। তার মত মুক্তমন ও সামাজিক একজন মানুষের মাদ্রাসায় চাকরি করা বেশ কঠিন। কারণ মাদ্রাসার সাধারণ শিক্ষকগণ অনেক ভদ্র, বিনয়ী ও মিশুক হলেও প্রধান নিবার্হী প্রায়ই অসামাজিক ও বিদঘুটে চরিত্রের হয়। প্রায় তিন বছর মাদ্রাসায় প্রভাষক পদে চাকরি করে এ আমার অবাঞ্ছিত তিক্ত অভিজ্ঞতা। আমি শৈশব থেকেই মাওলানা বা হুজুরদের কাছাকাছি থেকে তাদের একজন ভক্ত হিসেবে বেড়ে উঠেছি। কিন্তু কিছু কিছু এই ধরনের লেবাসি মানুষ সমাজে এমন দুর্গন্ধ ছড়ায় যা বহুদিনের পঁচা লাশ থেকেও পাওয়া যায় না। তাই মনে হয় আমার মত মিহিরও একটু মুক্ত বাতাস খুঁজছিলেন। আর আল্লাহর রহমতে কিছু সময়ের ব্যবধানে আজ আমরা খোকসা সরকারি কলেজের শিক্ষক। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন এক, আর আল্লাহর পরিকল্পনা অন্য।
আমাদের ঐতিহ্যবাহী গর্বিত পরিবার ছেড়ে মিহির আজ অনেক দূরের অধিবাসী। দীর্ঘদিন একই প্রতিষ্ঠানে সহ-অবস্থানের মধ্যে ভুল ত্রুটি সবারই হতে পারে কিন্তু এমন চিরবিদায় আমরা কেউ কারো জন্য কামনা করি না। মিহির, আমাদের সহকর্মী, আপনার ইন্তেকালে আমরা গভীরভাবে শোকাহত । আপনাকে অনেক অনেক মিস করবো।
আজ মনে পড়ছে অনেক কথা। জাতীয় দিবসগুলোতে মাননীয় অধ্যক্ষ স্যারের নির্দেশ থাকে যথাসময়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে হবে। এ দায়িত্ব সাধারণত ক্রীড়া শিক্ষকের উপর অর্পিত থাকে। যেমন পাওয়ারফুল বাইক তেমনি শক্তিশালী মিহির। শীতকালের কোনো এক জাতীয় দিবস। দেখি ভোরে কলেজে এসে উপস্থিত। মাথার চুল চোখের পাতাসহ সমস্ত শরীর কুয়াশায় সাদা। সেদিনের সাদা কুয়াশার চাদর যেন আজ কাফনের কাপড় হয়ে মিহিরকে ঢেকে রেখেছে। আসলে এমন তরতাজা টাটকা স্বাস্থ্যবান মিহিরকে এখনই হারাতে হবে ভাবতে, মেনে নিতে, মনে খুব কষ্ট হচ্ছে।
এবার একটি হতাশা বা দুঃখের কথা বলি। আমাদের যে সহকর্মি স্বাভাবিকভাবে অবসরজনিত বিদায় নেয়,তার ঘরেও কলেজের একটি মানপত্র স্মৃতি স্বরূপ থাকে। কিন্তু মিহিরের ঘরে কলেজের কোন স্মৃতি থাকবে যেখানে জীবনের কুড়িটি বছর অতিবাহিত করেছেন??? এসব বিষয়ে আমাদের অবশ্যই ভেবে চিন্তে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এই কলেজে আমার যোগদান ৩১/০৭/২০০০খ্রী, গতকাল আমার ও মিহিরের চাকরির অভিজ্ঞতা ২১বছর পূর্ণ হয়েছে । যদিও আমি তার যোগদানের সঠিক তারিখ জানিনা তবে এই জুলাই মাসেই হবে আমার বিশ্বাস। হতে পারে কলেজের যোগদানের দিনটিই তার পৃথিবী থেকে বিদায়ের দিন। আল্লাহই ভালো জানেন, আমার ও আপনার জীবনের শেষ দিনটির কথা।
একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। মানুষ সৃষ্টিতে আল্লাহর সূত্র (মানুষ= দেহ + আত্মা)। মানুষ মারা গেলে আমরা সাধারণত দুটি শব্দ ব্যবহার করি। মৃত্যু ও ইন্তেকাল। তার মানে দেহের মৃত্যু হয় বা ধ্বংস হয়। আত্মার কোন মৃত্যু হয় না। ‘ইন্তেকাল’ শব্দের অর্থ স্থানান্তর(transfer)। এর অর্থ হলো আত্মার স্থানান্তর হয়। কোন দিন ধ্বংস হয় না। আসুন, নামাজ পড়ি আর সবাই সবার জন্য মন খুলে দোয়া করি।
হে আল্লাহ, মঞ্জুরুল আলম মিহিরকে আপনি জান্নাত দান করুন।আমিন।