প্রাইভেট কার সব মানুষের নেই। দূর যাত্রার সকল পরিবহণ বন্ধ। মাঝে মাঝে ফেরীগুলোও বন্ধ রেখে ভোগান্তি বাড়ানো হয় আর ঘর মুখো মানুষগুলোকে নিয়ে ট্রল করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর কোন এক মন্ত্রী মশাই বাড়িতে গিয়ে মায়ের সাথে ছবিতে দাঁত কেলিয়ে হাসছেন আর জানাচ্ছেন প্রিয়জনদের সাথে সাক্ষাতের অনুভূতির কথা। এটি বাংলাদেশ। ইউরোপ আমেরিকার মত কোন উন্নত ভূখন্ড আমরা পাইনি। হাতে গোনা কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ মানুষ ধনী থাকতে পারে(সঠিক কোন পরিসংখ্যান যদিও আমার জানা নেই)। আর বাঁকি সবাই আমার মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্য বিত্ত এবং দরিদ্রশ্রেণীর। ঢাকা শহরে যারা বসবাস করে থাকেন তাদের অধিকাংশই ভাড়াটিয়া। মানে যে যে পেশায়ই থাকুক না কেনো ভাড়ার বিনিময়ে বাসা নিয়ে সেখানে বসবাস করা হয়। পরিবার নিয়ে বসবাস করার সামর্থ সবার হয়না আর নাড়ীপোতা থাকে গ্রামে। সেখানে থাকেন মা বাবা বা অন্য সকল নিকট আত্মীয় স্বজন। তার মধ্যে অধিকাংশ গার্মেন্টস শিল্পের সাথে জড়িত মানুষ। তারা সারা বছর একটানা পরিশ্রম করে যা অমানষিক এবং অমানবিক। সকাল ৭টা থেকে কখনো কখনো রাতের ১২টা তক খাটতে হয়। পরিবারের লোকদের সাথে সময় দেওয়া তো দুরের কথা তাদের সাথে যোগাযোগ রাখাও কঠিন হয়ে পড়ে এসব মানুষের। ২টা ঈদে কয়েকটা দিন ছুটি হয় আর এই সময়টাই তাদের কাছে পরম পাওয়া। ঘরে ফিরতে ছটফট করা মনকে ঈদ এলে আর ধরে রাখা যায়না। আবার সকলেই যে মনের টানেই ঘরে ফেরেন এমনটি নয় তাদের ঘরে ফেরাটা অত্যাবশ্যকীয়ও হয়ে পড়ে কখনো কখনো। কেনো অত্যাশ্যকীয় হয়ে পড়ে তার ব্যাখ্যায় গিয়ে চলমান লেখার কলেবর বৃদ্ধি করতে চাইনা। এবার ঈদে সরকারী বেসরকারী সকল চাকরীজীবিদের সকলকে কর্মস্থলে থাকতে বলা হয়েছে। এটি সরকারী নির্দেশনা। কিন্তু সরকারের এমন কোন নির্দেশনা জনগন জানেনা যে, যারা চাকরীজীবি নয় তারা কিন্তু বিভিন্ন পেশার সেই সকল মানুষের কি হবে? করোনা ভাইরাসংক্রমণের এই ২য় দফার ধাক্কা সামলাতেই যখন এই লক ডাউন তখন মার্কেট, বিপণীবিতাগুলো গুলো খুলে রাখার মানে কি? আকাশ পথ খোলা। টাকা থাকলেই উড়াল দেওয়া যায় অনায়াসেই। প্রাইভেট কার থাকলে তাওে আর আটকায় কে? থাকলে হোন্ডা নিয়েও যাওয়া যায়। মাইক্রোবাস পিকআপ সব চলছে। তবু ট্রল করছে দেখা যাচ্ছে এই ঘর মুখো খালি হাত পায়ের মানুষ গুলোকে নিয়ে। গত বছর দেখেছিলাম ঢাকা খেতে বাড়িতে যাওয়াই দূষ্কর ছিলো। আমি নিজেও বাড়িতে গিয়ে পড়েছিলাম মারাত্মক বিড়ম্বনায়। মহল্লার চৌকিদার গুলিকে দেখেছিলাম কঠোর পদক্ষেপ নিতে। ঢাকা ফেরত কোন সদস্য থাকলে সেই বাড়িতে লাল ফ্লাগ টাঙিয়ে প্রতিবেশিকে সতর্ক করতে দেখা গেছে। বুঝাতে চেয়েছিলো যারা ঢাকা থেকে বাড়িতে যায় তারা অচ্ছুৎ., অপয়া। তাদের বাড়ির আশ দিয়েও যেনো কেউ না যায়। কিন্তু এবারকার কনসেপ্টটা ভিন্ন। এবার গ্রামে গিয়ে তেমন কোন বিড়ম্বনার শিকার হবার খবর আমার কাছে আসেনি। যাহোক, মানুষ বাড়িতে যাচ্ছে। দূর পাল্লার বাসে যেতে না পারলেও তারা অটো রিকশাতে, সিএনজিতে যে যে ভাবে পারছে যাচ্ছে। তাদের পকেটের টাকা খুইয়েই তারা যাচ্ছে। ৩০০ টাকার ভাড়ায় তিন হাজার টাকা পড়লেও যেতে হচ্ছে তাদের। তাদের যেতেই হবে। বিশেষ করে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের এই যাওয়াতে ভোগান্তি সীমা নেই। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে ফেরিসহ যাত্রী পারাপারের সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। জনস্রোত নিয়ন্ত্রণে শনিবার সন্ধ্যা থেকে দুই ঘাটে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। তবে, জনস্রোত তো থামেইনি, উল্টো দুই ঘাটে কোনো ফেরি নোঙর করলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে হাজারো মানুষ। একেকটা ফেরিতে চার-পাঁচ হাজার করে মানুষ পার হচ্ছে, যাদের বেশিরভাগই হয়তো নিম্ন আয়ের মানুষ।
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ট্রল, হাসি-তামাশা, দোষারোপ চলছে। যেন ফেরিতে পারাপার হওয়া মানুষগুলোই শুধু করোনা ছড়াচ্ছে। তারাই যেন শুধু অপরাধী। না, ফেরিতে গাদাগাদি করে বাড়ি যাওয়া কোনোভাবেই সমর্থন করছি না। সেটা লিখতেও বসিনি। কিন্তু, কথা হলো, লাখো মানুষ কেন এভাবে যাচ্ছে? বিকল্প কিছু কি করার ছিল না?
আবার একই দেশে এত নিয়ম কেন? যার গাড়ি আছে সে যদি যেতে পারে, তাহলে যার কিছু নেই সে কেন যাবে না? এখন আমাদের উদ্দেশ্য কী? গরিব মানুষের ঈদযাত্রা বন্ধ করা, নাকি করোনা ঠেকানো? যদি করোনা ঠেকানোই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে কেন বিকল্প ভাবনা নেই?
এই যে দেখেন, একটা দল উড়োজাহাজে করে যেখানে খুশি যেতে পারবে, সমস্যা নেই। করোনাকালে যারা বিমানবন্দরে গিয়েছেন তারা জানেন, কখনো কখনো এত ভিড় হয়েছে যে দেখলে চট করে গুলিস্তান মনে হতে পারে। কিন্তু, সেই ছবি নিয়ে কোনো হাসাহাসি হয়নি।
আবার দেখেন, উত্তরাঞ্চলের পথে মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, ছোট গাড়ি— সবই আছে। তাহলে আনুষ্ঠানিকভাবে বাস চলছে না কেন? করোনার ভয়ে? যে মাইক্রোবাসে আট জন বসার কথা, সেখানে গাদাগাদি করে ১৬ জন যাচ্ছে। সেখানে করোনার ভয় নেই? মাইক্রোবাসে গাদাগাদি না করে বাসে ১৬ জন গেলে ঝুঁকি কি কমত না? তাহলে কেন বাস বন্ধ আর মাইক্রোবাস চলবে? বিষয়টা কি এই যে, বাসে করোনা ছড়াবে, মাইক্রোবাসে ছড়াবে না? আচ্ছা, ঈদ উপলক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দূরপাল্লার বাস-ট্রেন বা লঞ্চ চালু রাখলে সমস্যা কতটা হতো? সব লোককে যদি ঢাকা থেকে গাড়িতে নেওয়া যেত, তাহলে তো পথে পথে তাদের ওঠানামা করতে হতো না।