ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের এক অনন্য ঘটনা
মিজানুর রহমান মিজান
কোন দেশ বা জাতির রাজনৈতিক চেতনা ও জাতীয়তাবোধ নস্যাৎ করতে হলে সর্বাগ্রে তার ভাষা , সাহিত্য , সংস্কৃতি উপর ধবংসাত্মক আঘাত হানা প্রয়োজন। এ বাক্যে অনুপ্রানিত হয়ে ১৯৪৭ সালে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের শাসক গোষ্টি পূর্ব পাকিস্তানের উপর শুরুতেই চালায় বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্রের ষ্টীম রোলার। তাই দেখা যায় ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে বাংলা ভাষা কেড়ে নেয়ার প্রচেষ্টারত। বাঙ্গালীরা তা অনুধাবন করতে পেরে ১৯৪৭ সালের ২রা সেপ্টেম্বর ” তমদ্দুন মজলিস” নামক সংগঠন গড়ে বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে লেখালেখি শুরু করেন। এমন কি অক্টোবর মাসে সর্ব প্রথম ” রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ ” গঠন করেন এবং ডিসেম্বর মাসে করাচিতে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা রুপে প্রতিষ্টার ঘোষণা দেয়া হয়। ঘোষণা আসার পর পরই এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৬ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এক সমাবেশের মাধ্যমে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা , শিক্ষার মাধ্যম করার জোরালো দাবী হিসাবে গ্রহণের প্রস্তাব গৃহিত হয়।
অত:পর ১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারী গণ পরিষদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি কুমিল্লার ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বাংলাকে অন্যান্য ভাষার সাথে অন্যতম ভাষা রুপে ব্যবহারের দাবী সম্বলিত প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সে অধিবেশনেই লিয়াকত আলী খান , নাজিম উদ্দিন প্রমুখ মুসলিম লীগ নেতা প্রস্তাবের বিরোধিতা করলে ২৬ শে ফেব্রুয়ারী ছাত্ররা ক্লাস বর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার স্বপক্ষে শ্লোগান তোলেন।
বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্টিত করার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালে ২রা মার্চ সর্বদলীয় পরিষদ হিসাবে ” রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ ” নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা হয় এবং এ পরিষদ সরকারি তালিকা থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেবার প্রতিবাদে ১১ই মার্চ পূর্ব বাংলায় এক সাধারণ ধর্মঘট পালন কালে পুলিশ বিভিন্ন স্থানে লাঠি চার্জ করলে অনেক নেতা আহত ও গ্রেফতার হন। পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৩ই মার্চ হতে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সকল জেলাতেই ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়াতে ১৫ই মার্চ নাজিম উদ্দিনের সাথে সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের পর পর দু’টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং সাত দফা সম্বলিত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবু ও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২১ শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবং ২৪ শে মার্চ কার্জন হলে ঘোষণা করেন ” উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা”। সাথে সাথে ছাত্র সমাজ না , না ধবনিতে প্রতিবাদ জানান সোচচার কণ্ঠে। বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্টিত করতে এ দেশের ছাত্র সমাজের ভুমিকা , গুরুত্ব অতুলনীয়।
পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৫০ সালে আবারো ঘোষণা দেন পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে উর্দু বলে। ১৯৫২ সালের ২৬ শে জানুয়ারী খাজা নাজিম উদ্দিন এক জনসভায় ঘোষণা করেন , ” উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা”। তাৎক্ষণিক এ দেশের ছাত্র সমাজ , বুদ্ধিজীবি মহল অত্যন্ত ক্ষোভ ও দারুণ হতাশায় পড়ে যান। তাঁেদর চিন্তা ধারা হল শাসক গোষ্টির সহিত আন্দোলন সংগ্রাম ব্যতিত ভাষার প্রশ্নে বিকল্পতা চলবে না। তাই ছাত্রদের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ” রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করে ৩০ শে জানুয়ারী প্রতিক ধর্মঘটের মাধ্যমে সভা আহবান করা হয়। আবার ৩১ শে জানুয়ারী সর্বদলীয় সভা আহবান করে খাজা সাহেবের বিরুদ্ধে নিন্দা , ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানানো হয়। ছাত্র সমাজ এখানেই থেমে থাকেননি। ৪ঠা ফেব্রুয়ারী সর্বদলীয় ” রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ” নামে একটি সভায় মিলিত হন এবং এ সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ২১ শে ফেব্রুয়ারী প্রদেশ ব্যাপি সাধারণ ধর্মঘট ও ভাষা দিবস হিসাবে ঐদিন পালন করা হবে। তাছাড়া ভাষার মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্টিত না করা পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাবার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে নেতারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
এদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ছাত্র নেতা মহি উদ্দিন আহমেদ ” রাজবন্দীর মুক্তি ” ও ”রাষ্ট্রভাষা বাংলার ” দাবীতে আমরণ অনশন শুরু করলে আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে উঠে। অবস্তা বেগতিক দেখে শাসক চক্র ২০ শে ফেব্রুয়ারী থেকে ৩০ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা জারী করে মিছিল মিটিং সম্পূর্ণ রুপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তাই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সভায় বসে অধিকাংশ সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে সিদ্ধান্তে উপনীত হন। সুতরাং ২১ শে ফেব্রুয়ারী সকাল দশটায় ছাত্ররা জমায়েত হয়ে সংখ্যা গরিষ্ট নেতৃবৃন্দের সম্মতিতে উত্তেজিত হয়ে মিছিল করতে থাকেন ” ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে হবে ” , ”রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” ইত্যাদি শ্লোগান। দফায় দফায় ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ , ইটপাটকেল নিক্ষেপ চলতে থাকে। বেলা তিনটার দিকে অবস্তার অবনতি শুরু হলে ছাত্ররা প্রাদেশিক আইন পরিষদের দিকে মিছিল নিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ গুলি বর্ষণ শুরু করে এবং পুলিশের গুলিতে ছাত্র নেতা বরকত , রফিক , সালাম , জব্বার ও শফিউর সহ আরো অনেকে শহিদ ও আহত হন। সাথে সাথে সারা পূর্ব বাংলায় দাবানলের মত আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন ২২ শে ফেব্রুয়ারী থেকে ২৭ শে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত দেশের সর্বত্র ধর্মঘট পালনের। এ সময় শহিদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার নিমিত্তে ছাত্র জনতা ঢাকা মেড়িকেল কলেজের সম্মুখে শহিদ মিনার নির্মিত করে শফিউরের পিতাকে দিয়ে মিনারটি উম্মোচন করেন।
ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলি চালাবার সংবাদ পেয়ে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী রাত্রে রোগ শয্যায় শায়িত থেকে চট্রগ্রামের মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী প্রথম যে কবিতা রচনা করেন তা হল –
” আমি কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি ”
ওরা চল্লিশ জন কিংবা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রৌদ্র দগ্ধ
কৃষ্ণ চুড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য , মাতৃভাষার জন্য , বাংলার জন্য
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য
……………………………………………….।
বাংলাদেশের মানুষ গভীর সম্মান ও শ্রদ্ধাভরে ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে প্রতি বৎসর ” শহিদ দিবস , মাতৃভাষা দিবস” রুপে পালন করেন ১৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। কিন্তু ১৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ১৮৮ জাতি সম্বন্বয়ে সংগঠিত জাতি সংঘের শিক্ষা , বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো প্যারিস অধিবেশনে ” একুশে ফেব্রুয়ারী ” কে আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস ” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এ জাতির একটি বিশিষ্ট অর্জনকে আন্তজার্তিক স্বীকৃতি প্রদান করেছে। সেদিন থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদায় পালিত হচেছ পৃথিবীর বুকে বাঙ্গালী জাতির গৌরবান্বিত এ দিবসটি। অপর দিকে ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথকে করে প্রসারিত , প্রশস্থ। ভাষা আন্দোলনের চেতনা স্বাধীনতা আন্দোলনকে করে তোলে ত্বরান্বিত। ৫২’র ফেব্রুয়ারীতে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা , আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্টিত করতে পারলে ও অত্যন্ত দু:খ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলতে হয় আজ ও বাংলা ভাষাকে আমরা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি সর্বত্র। এটা আমাদের হীন মন্যের পরিচয় নয় কি ? উদাহরণ স্বরুপ বলতে তথ্য প্রযুক্তির সীমাহীন উৎকর্ষ সাধনের যুগে এসে ও আমরা সর্বত্র বাংলা ভাষার যথোপযুক্ত প্রয়োগ , ব্যবহার বৃদ্ধি করতে সক্ষমতা অর্জনে এক প্রকার ব্যর্থতার পরিচয় দিচিছ। আটই ফাল্গুন পালন বা বলতে আমাদের যেন মনে সংকোচ , দ্বিধা-দ্বন্ধে ভুগতে হয়। এ যদি হয় আমাদের মনের অবস্তা , তবে শহিদ ভাইদের আত্বা কি সন্তুষ্ট হবে ? সুতরাং শহিদ ভাইদের সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের লক্ষ্যে হলে ও অন্ততপক্ষে ইংরেজি থেকে উত্তোরণ আমাদের নিদেন পক্ষে দেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। তাছাড়া ও ইদানিং ফেসবুক ইত্যাদিতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বাংলাকে ইংরেজিতে লেখতে গিয়ে বাংলা ভাষা অনেক সময় বিকৃত রুপ ধারণ করে বা পরিলক্ষিত হয়। পরিশেষে আমার আকুল আবেদন থাকবে সংশ্লিষ্ট উচচ মহলের প্রতি এ ব্যাপারে একটু সচেতনতা অবশ্যই করণীয় বোধে সহজ সাধ্য ও অনায়াসে বাংলা ভাষা কম্পিউটারে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না , মোবাইলে অনেক মেসেজ সরকারি প্রদান করা হয় বাংলাকে ইংরেজিতে লিখে। তাতে বর্তমান প্রজন্ম বা যে কেউ অনুপ্রাণিত হতে পারে। তাই সরকারি ভাবে বা সরকার এ ব্যাপারে সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি দিলে অনেকটা ফলপ্রসু হতে পারে। অথবা আইন , বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তি প্রদান করে সতর্কতা অবলম্বন জরুরী বিবেচনায় নেয়া অপরিহার্য।
লেখক – মিজানুর রহমান মিজান, সাবেক সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব
সম্পাদক দীপ্তি
ডাক – রাজাগঞ্জ বাজার ৩১৩০
উপজেলা – বিশ্বনাথ , সিলেট।