বিশ্বাস ও আশা
– কাজী নজরুল ইসলাম
বিশ্বাস আর আশা যার নাই, যেয়ো না তাহার কাছে,
নড়াচড়া করে, তবুও সে মড়া, জ্যান্ত সে মরিয়াছে।
শয়তান তারে শেষ করিয়াছে, ইমান লয়েছে কেড়ে,
পরান গিয়াছে মৃত্যুপুরীতে ভয়ে তার দেহ ছেড়ে!
থাকুক অভাব দারিদ্র্য ঋণ রাগ শোক লাঞ্ছনা,
যুদ্ধ না করে তাহাদের সাথে নিরাশায় মরিয়ো না।
ভিতরে শত্রু ভয়ের ভ্রান্তি, মিথ্যা ও অহেতুক |
নিরাশায় হয় পরাজয় যার, তাহার নিত্য দুখ।
‘হয়তো কী হবে’ এই ভেবে যারা ঘরে বসে কাঁপে ভয়ে,
জীবনের রণে নিত্য তারাই আছে পরাজিত হয়ে।
তারাই বন্দি হয়ে আছে গ্লানি–অধীনতা কারাগারে;
তারাই নিত্য জ্বালায় পিত্ত অসহায় অবিচারে!
এরা অকারণ ভয়ে ভীত, এরা দুর্বল নির্বোধ,
ইহাদের দেখে দুঃখের চেয়ে জাগে মনে বেশি ক্রোধ।
এরা নির্বোধ, না করে কিছুই জিভ মেলে পড়ে আছে।
গোরস্তানেও ফুল ফোটে, ফুল ফোটে না এ মরা গাছে।
এদের যুক্তি অদৃষ্টবাদ, বসে বসে ভাবে একা,
“এ মোর নিয়তি, বদলানো নাহি যায় কপালের লেখা! |
পৌরুষ এরা মানে না, নিজেরে দেয় শুধু ধিক্কার,
দুর্ভাগ্যের সাথে নাহি লড়ে মেনেছে ইহারা হার।
এরা জড়, এরা ব্যাধিগ্রস্ত, মিশো না এদের সাথে,
মৃত্যুর উচ্ছিষ্ট আবর্জনা এরা দুনিয়াতে।
এদের ভিতরে ব্যাধি, ইহাদের দশদিক তমোময়,
চোখ বুজে থাকে, আলো দেখিয়াও বলে, “ইহা আলো নয়।
প্রবল অটল বিশ্বাস যার নিশ্বাস প্রশ্বাসে,
যৌবন আর জীবনের ঢেউ কল–তরঙ্গে আসে,
মরা মৃত্তিকা করে প্রাণায়িত শস্যে কুসুমে ফলে,
কোনো বাধা তার রুধে নাকো পথ, কেবল সুমুখে চলে,
চির–নির্ভয়; পরাজয় তার জয়ের স্বর্গ–সিড়ি,
আশার আলোক দেখে তত, যত আসে দুর্দিন ঘিরি।
সেই পাইয়াছে পরম আশার আলো,
যেয়ো তারই কাছে, তাহারই নিকটে মৃত্যুঞ্জয়ী অভয়–কবচ আছে।
যারা বৃহতের কল্পনা করে, মহৎ স্বপ্ন দেখে,
তারাই মহৎ কল্যাণ এই ধরায় এনেছে ডেকে।
অসম্ভবের অভিযান–পথ তারাই দেখায় নরে,
সর্বসৃষ্টি ফেরেস্তারেও তারা বশীভূত করে।
আত্মা থাকিতে দেহে যারা সহে আত্ম–নির্যাতন,
নির্যাতকেরে বধিতে যাহারা করে না পরান–পণ,
তাহারা বদ্ধ জীব পশু সম, তাহারা মানুষ নয়,
তাদেরই নিরাশা মানুষের আসা ভরসা করিছে লয়।
হাত–পা পাইয়া কর্ম করে না কূর্মধর্মী হয়ে,
রহে কাদা–জলে মুখ লুকাইয়া আঁধার বিবরে ভয়ে,
তাহারা মানব–ধর্ম ত্যজিয়া জড়ের ধর্ম লয়,
তাহারা গোরস্তান, শ্মশানের, আমাদের কেহ নয়!
আমি বলি, শোনো মানুষ! পূর্ণ হওয়ার সাধনা করো,
দেখিবে তাহারই প্রতাপে বিশ্ব কাঁপিতেছে থরথর।
ইহা আল্লার বাণী যে, মানুষ যাহা চায় তাহা পায়,
এই মানুষের হাত পা চক্ষু আল্লার হয়ে যায়!
চাওয়া যদি হয় বৃহৎ বৃহৎ সাধনাও তার হয়,
তাহারই দুয়ারে প্রতীক্ষা করে নিত্য সর্বজয়।
অধৈর্য নাহি আসে কোনো মহাবিপদে সে সেনানীর,
অটল শান্ত সমাহিত সেই অগ্রনায়ক বীর।
নিরানন্দের মাঝে আল্লার আনন্দ সেই আনে,
চাঁদের মতন তার প্রেম জনগণ–সমুদ্রে টানে।
অসম সাহস আসে বুকে তার অভয় সঙ্গ করে,
নিত্য জয়ের পথে চলো সেই পথিকের হাত ধরে!
পূর্ণ পরম বিশ্বাসী হও, যাহা চাও পাবে তাই,
তাহারে ছুঁয়ো না, সেই মরিয়াছে, বিশ্বাস যার নাই!
(শেষ সওগাত কাব্যগ্রন্থ)