বটতলার শীতল ছায়া
গোলাপ মাহমুদ সৌরভ
আহারে শৈশব কতোই না সুন্দর ছিল কতো আনন্দ উল্লাসে ঘুরেফিরে কেটেছে ইচ্ছে করে আবার ফিরে যাই সেই ছেলেবেলা।একটা সময় পাড়ার সকল বয়সের মানুষেরা গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমে যখন ঘরে বসে থাকা যেতো না তখনই গ্রামের মানুষজন খালি গায়ে গলায় একটা গামছা পেচিয়ে চলে যেতো সেই পাড়াতলী নতুন পাড়া গ্রামের দৌলত সরকারের বাড়ির পুকুর পাড় বটতলায়। পুকুর পাড়ে একটা পুরনো বটগাছ ছিল যেমন উঁচু তেমনই মোটা চারদিকে গাছের ঘোড়াটা এমন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মানুষ বসে শুইয়ে সময় কাটাতে পারতো আর ডালপালা গুলো যেন মস্ত বড়ো একটা ছাতার মতো ছড়িয়ে ছিল তার নিচে বসে থাকলে কতোটা প্রশান্তি অনুভব হয় তা এখনো উপলব্ধি করা যায়। কেউ বটগাছের মূলের উপর শুইয়ে ঘুমিয়ে যেতো মনে হতো ঘরে গিয়ে গরমের হাহাকার এর চেয়ে বটতলা বসে থাকা ভালো।
গ্রীষ্মের দুপুর বেলা মানুষ কাজের থেকে ফিরে চলে যেতো বটতলা গাছের ছায়া আর শীতল বাতাস মনটা জুড়িয়ে যেতো। বুড়ো বয়সের লোকেরা বসে তাস খেলতো যুবক ছেলেরা গুল্লি খেলা, ষোলগুটি, লুডু খেলা, দাগ্গি খেলা, আর ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বৌছি, কানামাছি ভোঁ, দৌড়াদৌড়ি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, নুনের বস্তা, লুকোচুরি খেলায় বেস্ত থাকতো আবার কয়েকজন মিলে বসে বিভিন্ন ধরনের রুপকথার গল্প, ভূতের গল্প, সিনেমার গল্প ইত্যাদি বলে সময় পাড় হতো। আবার বটের ডালে বসে কোকিল কোকিলা মিলে মিষ্টি মধুর সুরে কুহুকণ্ঠে বেতালা সুর তোলে গান গাইতো। বউ পাখি চৈতার মাগো টাকা দাওগো গান গাইতো। ছোট ছেলে-মেয়েরা বটতলায় বসে কোকিলের সুরে সুরে কুহু কুহু করে ডাকলে কোকিলা বড্ড রেগেমেগে আরও বেশি করে ডাকতো আর টিয়া বুলবুলিরা বটের গুটি গুলো খেয়ে নিচে মানুষের উপরেই হেগে দিতো। কখন যে দুপুর ফুরিয়ে সন্ধ্যা হতো বলাই যেতোনা কেউ কেউ আবার বটতলার শীতল বাতাসে খাবারের কথা ভুলে যেতো।
আজও সেই বটের ছায়া স্মৃতির বেলায় খুবই মনে পড়ে আবার যদি ফিরে পেতাম সেই হারিয়ে যাওয়া বটতলার শৈশব কতোই না আনন্দ হতো কিন্তু ইচ্ছে করলেই শৈশব কৈশোর ফিরে পাওয়া যায় না কারণ অতীত কখনো ফিরে আসে না শুধু স্মৃতি গুলোই মনের বারান্দায় পড়ে রয় স্মৃতির জানালা খুলে। মানুষের জীবন টা বড়ই অদ্ভুত বুঝার সাধ্য কারোই নাই। বয়সের ভাড়ে শুধু মানুষের দেহ নুইয়ে পড়ে না প্রতিটি প্রাণীর গায়ের জোর মনের বল সবকিছুই নিস্তেজ হয়ে পড়ে তেমনি গাছপালা ও ডালপালা গুলো আস্তে আস্তে মরে যায় একটা সময় পুরো গাছটাই মরে যায় কিন্তু তার যৌবনের শীতল ছায়া ফুল ফল দিয়ে যে মানুষের মনে জায়গা করে নেয় তা মানুষ সারা জনম মনে রাখে এবং স্মৃতির পাতা খুঁড়ে অতীতের দিন গুলো সযত্নে সংরক্ষণ করে। এই বটগাছটা কে লাগিয়ে ছিলো কেউ বলতে পারে না নিশ্চয়ই পূর্ব পুরুষেরা লাগিয়ে ছিলো এক বয়স্ক দাদা ছিল তার বয়স ছিল প্রায় নব্বই বছর তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো আচ্ছা দাদা ভাই এই বটগাছটা কে লাগিয়ে ছিলো আপনি জানেন কী? তিনি উওরে বলেছিলেন’ না’ আমি জানি না তিনি ( দাদা) বললেন ছোট বেলা থেকেই গাছটি দেখে আসছি এমনকি আমার বাবাও দেখেছে।
তাহলে আন্দাজ করা যায় গাছটির বয়স প্রায় দুই আড়াইশ বছর হবে কিন্তু আজ আমরা যখন বড় হলাম আমাদের ঘরে পরবর্তী প্রজন্ম এলো তারা তা দেখতে পারলোনা তাদের কাছে আমরা গল্প করি এই গরম আমরা এতোটা বুঝিনি কারণ ঐ বটগাছটা বেঁচে থাকলে আজও এতো কষ্ট হতো না তার ছায়াতলে বসে ঠান্ডা বাতাসে মনটা জুড়িয়ে যেতো। আজ এই তীব্র দাবদাহে যখন অসহ্য যন্ত্রণা মানুষ বিরক্ত বোধ করে তখনই মনে পড়ে শৈশবের সেই বটতলার শীতল ছায়া আজও হৃদয় পুড়ে তোমারই মায়া সেই পুকুর পাড় এখনো সেই আগের মতোই আছে কিন্তু ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছটা শুধু নেই তাই আজ এই গরমে অতিষ্ঠ যখন সেই স্মৃতি বিজারিত বটগাছটার কথা বারবার মনে পড়ছে পুকুর পাড়ে এখন প্রচন্ড রোদের তাপদহন চলে যেখানে বইত শান্তির নির্মল বাতাস আর শীতল ছায়া।
আজ আর সেই পাড়াতলী নতুন পাড়া গ্রামের সেই মানুষ গুলো পুকুর পাড়ে বসে আড্ডা দেয় না শুধু আপসোস করে যদি সেই বটগাছটা আজও বেঁচে থাকতো তাহলে এই গ্রামের মানুষ গুলোর এতো কষ্ট হতো না তার ছায়াতলে বসে একটু স্বস্তি খুঁজে পাওয়া যেতো। গরম কাল আসলেই বুঝা যায় একটা গাছ মানুষের কতো উপকারে আসে প্রতিটি নিঃশ্বাসে গাছের অক্সিজেন গ্রহণ করে তার শীতল ছায়া আশ্রয় খুঁজে কতটা গুরুত্বপূর্ণ গাছ মানুষের জীবনের ভূমিকা পালন করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না তাই আসুন আমরা আমাদের রাস্তা ঘাট পুকুর পাড়ে এবং বাড়ির আশেপাশে প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগাই পরিবেশ বাঁচাই। মনে রাখা উচিত গাছ মানুষের ভালো বন্ধু তাই নিরাময় নিরাপদ জীবন গড়তে, গাছ লাগান নিজস্বার্থে।