ধর্ষিতা বনাম পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্হা
শামীমা আক্তার
মিতা নামের মেয়েটি খুব মিষ্টি দেখতে । সব সময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করে । বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে, ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করে।
এক মফস্বল শহরে মেয়েটির জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই হাসিখুশি ও মিশুক স্বভাবের মিতা সবার খুব প্রিয় ছিল। মিতার গানের গলা খুব চমৎকার! অসম্ভব সুন্দর করে গান গাইতে পারে মেয়েটি। মিতা এখন কলেজে পড়ে। স্কুল জীবন শেষ করে সবেমাত্র কলেজে পা রেখেছে। ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে সে। সদ্য যৌবনে পা রাখা মেয়েটিকে দেখে এলাকার ছেলে ছোকরার যেন চোখ ফেরে না। কলেজে আসা যাওয়ার পথে ছেলেরা মিতাকে বিরক্ত করে, কেউ শিস বাজায়, কেউ চিঠি দেয়, কেউ সরাসরি প্রপোজ করে। প্রতিদিন এই ধরনের উপদ্রব পোহাতে হয় মেয়েটিকে। কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে গান গাইলো মিতা। চমৎকার তার গানের গলা! মিতার গান শুনে কলেজের সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো।
মিতাকে আজ দেখতে খুব সুন্দর লাগছে! মেরুন রঙের শাড়িতে একদম ডানাকাটা পরীর মতো লাগছিল ওকে। নবীনবরণ অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত হয়ে গিয়েছিল। মিতা তার বাড়ির পথে রওয়ানা দিল। কলেজ থেকে মিতাদের বাড়ি বেশি দূরে নয়, হেঁটে চলে যায় সে। কিছুদূর যাওয়ার পর কলেজের এক বখাটে ছেলে মিতার পথরোধ করে দাঁড়ালো। মিতা ছেলেটিকে চিনতে পারলো। কলেজে যাওয়া আসার পথে ছেলেটা মিতাকে খুব বিরক্ত করে। ছেলেটার নাম কামাল। মিতা কিছু বলতে যাবে, অমনি কামাল মিতার মুখ চেপে ধরে তাকে পথের পাশের বাঁশবাগানে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করলো। তারপর পালিয়ে গেলো। মিতা বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরলো।
প্রথমে মিতার পরিবার জানলো বিষয়টি। তারপর আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাই জানলো। মিতার বাবা কামালের নামে ধর্ষণের মামলা করলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। টাকা ও ক্ষমতার জোরে কামাল পার পেয়ে গেলো! তার কোনো বিচার হলো না! কারণ কামালের বাবা হলেন একজন বিত্তবান ও প্রভাবশালী লোক। মামলা মোকদ্দমা হওয়ায় মিতার ধর্ষণের ঘটনা পত্র পত্রিকায় ছাপা হলো,পত্রিকায় মিতার ছবি ছাপা হলো! টেলিভিশনে খবর প্রচার হলো। ধর্ষিতা হিসেবে মিতা সমাজে পরিচিতি পেলো! কিন্তু ধর্ষক কামালের ছবি কোথাও ছাপা হলো না! তাই কামাল বেঁচে গেলো!
কামাল সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়! অন্যদিকে মিতা লজ্জায় ঘর থেকে বের হতে পারে না। কারণ সবাই যে তাকে ধর্ষিতা হিসেবে জানে! বাড়ির বাইরে গেলেই সবাই তার দিকে আঙুল তুলে বলে এই মেয়েটি ধর্ষিতা! কলেজে যাওয়াও বন্ধ করতে হলো মিতাকে! মিতা এখন ঘরে বসে সারাদিন কান্নাকাটি করে। মিতাকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। কারণ ধর্ষিতা মেয়ে যে নষ্টা! আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষিতা মেয়ের কোনো স্হান নেই! পড়ালেখা বন্ধ, বিয়ে হচ্ছে না,পাড়া প্রতিবেশীর নানান ধরনের কটুকথা শুনতে শুনতে মিতা এখন বড় ক্লান্ত। ধর্ষিতা হবার লজ্জা যে বড় ভয়ংকর! এ লজ্জা সে রাখবে কোথায়? ধর্ষকের তো কোনো লজ্জা নেই! সব লজ্জা, সব গ্লানি, সব অপমান, সব লান্ছনা যে ধর্ষিতার! তাই এতো লজ্জা আর অপমানের ভার আর বহন করতে পারলো না মিতা। এই লজ্জার হাত থেকে মুক্তি পেতে একদিন গলায় দড়ি দিলো মিতা। আত্মহত্যার মাধ্যমে বেছে নিলো তার মুক্তির পথ! কারণ এছাড়া যে তার এই লজ্জা থেকে মুক্তি নেই! বেঁচে থাকলে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্হায় ধর্ষিতাদের যে এই লজ্জা থেকে মুক্তি নেই!