লাল ঘুড়ি
জিল্লুর রহমান লালন
খোকসা কুষ্টিয়া।
আদিত্য ধানমণ্ডি বয়েজ হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। তার মা-বাবা দু’জনেই সরকারি চাকুরী করে। আদিত্যের দাদা বাড়ি কুষ্টিয়ার – খোকসায়। তার ছোট একটা বোন আছে । নাম অবনী। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে অবনীর সাথে খেলা করে। বিভিন্ন ধরনের গল্পের বই পড়ে শোনায়। ভূতের গল্প অবনীর খুব ভাল লাগে। অবনীও খুব মজা পায় খেলা করতে ও মজার মজার গল্প শুনতে। ছুটি পেলেই আদিত্যের বাবা- মা ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যায় গ্রামের বাড়িতে।
দাদু বাড়িতে খুব ভাল লাগে আদিত্য ও অবনীর। খোলামেলা পরিবেশ, মেঘ মুক্ত নীল আকাশ, সবুজ ফসলের মাঠ, খেলার অনেক সঙ্গী -সাথী। আকাশে ঘুড়ি উড়ানো, পুকুরে মাছধরা, কাকুর মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ানো সব কিছুই স্বপ্নের মতো মনে হয় ওদের কাছে। এছাড়া দাদির হাতের পিঠা -পায়েসের তো তুলনাই হয়না। তাইতো একবার গ্রামে গেলে আর ঢাকা ফিরতে চায়না তারা। আর ঢাকা ফিরলে শুরু হয় নতুন আবদার “আব্বু আমরা আবার কবে দাদু বাড়ি যাবো”? তার আব্বু অফিস থেকে ফিরে ছেলের মুখে ঐ একটা কথাই শুনবে ” আব্বু দাদু বাড়ি যাওয়ার টিকেট এনেছো”? আবার কবে দাদু বাড়ি যাবো? দাদু বাড়ির প্রতি ছেলের টান দেখে ভালও লাগে আবার মাঝে মাঝে বিরক্তও হয়।
বিরক্ত হয়ে বলে- চলো তোমাকে তোমার দাদুর কাছে রেখে আসি। আদিত্য বলে তাহলে তাই চলো, আমাকে দাদু বাড়িতে রেখে এসো।
এবার ঈদুল আজহা আর দুর্গা পুজা পাশাপাশি হওয়ায় একসাথে অনেকদিন ছুটি হয়েছে। বিষয়টা জানতে পেরে আদিত্য মহাখুশি। সে মনে মনে ভাবছে এবার অনেকদিন দাদু বাড়িতে থাকতে পারব। ঈদ আর দুর্গা পুজা মিলে মোট ১৫দিনের ছুটিতে দাদু বাড়ি এলো তারা। দাদু বাড়ি এসেই দাদুর সাখে ছুটল বর্শি নিয়ে পুকুরে মাছ ধরতে। দাদুও তাকে একটা ছোট বর্শি তৈরি করে দিল। সে মাাছ ধরতে বসে দাদুকে হাজারো প্রশ্ন করল। দাদু “তোমাদের পুকুরে কি কি মাছ আছে? সবচেয়ে বড় মাছের ওজন কয় কেজি হবে? মাছেরা কি খায়? পানির নিচে মাছ কিভাবে বাঁচে? এরকম প্রশ্ন একের পর এক করেই যাচ্ছে আদিত্য । দাদুও তার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। আর নাতীর কৌতুহলী মন দেখে মজা পাচ্ছে।
মাছ ধরা শেষে, দাদুর সাথে ছুটল এবার মাঠের দিকে। মাঠ ভরা সবুজ ফসল দেখে মনটা ভরে গেল আদিত্যের। হঠাৎ চোখ পড়ল আকাশের দিকে! দেখতে পেল নানা রঙের ঘুড়ি উড়ছে। এক একটি ঘুড়ির দিকে আঙ্গুল নির্দিষ্ট করে ঘুড়িটির নাম জানতে চাইছে। দাদুও উত্তর দিচ্ছে প্রশ্ন অনুযায়ী । এবার একটি বড় লেজওয়ালা ঘুড়ি দেখিয়ে বলল “দাদু এটি আবার কি ঘুড়ি? ” দাদু বলল সাপের মত অনেক বড় লেজ বলে একে “সাপা”ঘুড়ি বলে। আদিত্য বায়না ধরল দাদু আমাকে একটা ঘুড়ি বানিয়ে দাও। আমিও ওদের মত ঘুড়ি উড়াবো।
দাদু বলল,তোমার আব্বু বকা দেবে। ঘুড়ি পেলে তুমি শুধু রোদে রোদে ঘুড়ি উড়িয়ে বেড়াবে।
না-না দাদু, আমি রোদে যাবনা। তোমার সাথে বিকালে ঘুড়ি উড়াবো।
নাতীর জন্য দাদু লাল কাগজের একটি ঘুড়ি তৈরি করে দিল। পরের দিন বিকালে আদিত্য তার দাদুর সাথে লাল ঘুড়িটা আকাশে উড়িয়ে দিল। আদিত্যের লাল ঘুড়িটা পাখির মত আকাশে উড়তে লাগল। নাটাই থেকে যতোই সুতা ছাড়তে লাগল, লাল ঘুড়িটা ততোই উপরে উঠতে লাগল। ঘুড়িটা যত উপরে উঠছে সে ততো বেশি মজা পাচ্ছে। সে তার আব্বু, আম্মু,কাকু আর অবনীকে ডেকে দেখালো” দেখো আমার লাল ঘুড়িটা কত উপরে উঠেছে!বাবা আর ছেলের কাণ্ড দেখে মজা পায় আদিত্যের বাবা। বলে এবার তোমাকে তোমার দাদুর কাছেই রেখে যাব -যাতে মাঠে মাঠে দু’জন মজা করে ঘুড়ি উড়াতে পারো।
আদিত্য বলে, তাহলে তো খুব মজা হবে
আমি দাদুর সাথে সারাদিন ঘুড়ি উড়াব।
দিনের শেষে লাল সূর্যটা যখন অস্তাচলে দাদু তখন ঘুড়িটা নামাতে শুরু করল। ঘুড়ি যতোই নিচে নামছে আদিত্য ততোই মজা পাচ্ছে। অতঃপর ঘুড়িটা যখন মাটিতে নামল তখন সে দৌড়ে গিয়ে ঘুড়িটা ধরল এবং ঘুড়িতে চুমু খেলো। এরপর বাড়ি এসে রাতের খাওয়া শেষে দাদুর কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল।
আনন্দ -ফুর্তি আর হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে ১৫ দিনের ছুটি যে কিভাবে কেটে গেল তা বুঝতেই পারলো না। কর্মের তাগাদায় স্ব -গন্তব্যে ছুটতে হলো। ঢাকায় আর ফিরতে মন চায় না আদিত্যের।তবুও যেতেই হবে। কারণ স্কুল কামাই করলে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়বে। ঢাকায় যাওয়ার সময় দাদুর বানানো লাল ঘুড়িটা সাথে নিল সে।
বাবা এতো করে বলল, ঢাকায় ঘুড়ি উড়াবে কোথায়?
তবু সে নাছোড় বান্দা। দাদুর বানানো লাল ঘুড়িটা সে সাথে নেবেই। দাদু বলল, তুমি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করো, তোমাকে আরও সুন্দর ঘুড়ি বানিয়ে দেব।
দাদুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার ফিরল সে। ঢাকায় ফিরে লাল ঘুড়িটার দিকে তাকাতেই দাদুর কথা মনে পড়ল। খুব খারাপ লাগছে দাদুর জন্য। বার বার দাদুর সাথে কথা বলছে।”দাদু তেমাকে খুব মিস করছি। তোমার জন্য খুব খারাপ লাগছে। তুমি বেড়াতে এসো শিঘ্রই।
ওপাশ থেকে চোখের জল মুছে দাদু বলে ব্যস্ততা কমলেই আমি চলে আসব। তুমি মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করো,দুষ্টুমি করো না। আব্বু আম্মুর কথা মত চলবে।
ঠিক আছে দাদু। জানো দাদু, তোমার দেওয়া লাল ঘুড়িটা খুব যত্ন করে রেখেছি আর বন্ধুদের ও দেখিয়েছি।
দাদু বলল, খুব ভাল কথা। তাহলে এখন রাখি দাদু, তুমি ভালো থেকো এ কথা বলেই দাদু ফোনটা রেখে দিল। আদিত্যরা ঢাকা যাওয়ার পর থেকে দাদুর মনটা যেমন ভালো নেই তেমনি শরীরটাও খুব একটা ভাল যাচ্ছে না। তবুও কাউকে কিছু বলছে না। কারণ সবাই দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে সবে কর্মে ফিরেছে। নিজের অসুস্থতার কথা জানালে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে তাকে নিয়ে। আর অস্থিরতায় থাকবে সবাই তাই কাউকে কিছু জানায়নি সে।
এরপর কেটে যায় বেশ কিছু দিন। নগর জীবনের যান্ত্রিকতার সাথে তাল মিলাতে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সবাই। হঠাৎ সেদিন বাড়ি থেকে মায়ের ফোন। ওপাশ থেকে কান্না ভেজা কণ্ঠে মা বলছে “তোর বাবা ভীষণ অসুস্থ, তোরা এখনই বাড়ি আয়। ”
মায়ের ফোন পাওয়া মাত্রই আদিত্যের বাবা অফিস থেকে ফিরে স্ত্রী আর ছেলে -মেয়েকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। কিন্ত যতক্ষণে বাড়ি পৌঁছালো ততোক্ষণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে আদিত্যের দাদু ভাই। আদিত্য বাড়ি পৌঁছেই দাদু-দাদু বলে ডাকতে শুরু করল । কিন্তু দাদু আর কোন দিনই আদিত্যের ডাকে সাড়া দেবে না। অনেক লোকের ভীড় ঠেলে দাদুর কাছে গেল সে। সাদা কাফনে মুড়ানো দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আব্বু দাদু কথা বলছনা কেন? আব্বু দাদু কথা বলছে না কেন? দাদু তুমি কথা বলো! দাদু তুমি কথা বলো – একথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
দাদুকে হারিয়ে শোকে ভেঙে পড়ল সে। ঢাকায় ফিরে আর কোন ভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছিল না। বার বার দাদুর হাসিমাখা মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। লাল ঘুড়িটার দিকে তাকাতেই হু-হু করে কেঁদে ওঠে আদিত্য। লাল ঘুড়িটাকে জড়িয়ে ধরে দাদু,দাদু বলে কত যে চোখের জল ফেলেছে তার হিসেব নেই। বন্ধু-বান্ধবদের ডেকে ডেকে দেখায় এই দেখো আমার দাদুর বানানো লাল ঘুড়ি। এই দেখো আমার দাদুর বানানো লাল ঘুড়ি…..।
★★★★
Excellent
খুবই ভালো হয়েছে।