শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড একথা সর্বজন স্বীকৃত। জাতির এই মেরুদণ্ড কতটুকু শক্তিশালী কিংবা দূর্বল মূল প্রশ্নটা সেখানেই। মেরুদণ্ডহীন মানুষ যেমন সোজা হয়ে দাড়াতে পারেনা তেমনি শিক্ষা ছাড়াও কোন জাতির টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিজ্ঞজনেরা হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন যারা দেশের টাকা বিদেশ পাঠায় এবং দেশের প্রভূত ক্ষতি সাধন করেন তারা শুধু শিক্ষিত নয় বরং উচ্চ শিক্ষিত শ্রেনির এক অংশ। যারা এধরনের প্রশ্ন করেন বা করতে পারেন তাদের যথার্থ যুক্তি আছে। তাদের এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার আজকের লেখার বিষয় নয়। শুধু একটা কথাই বলব, উনারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও স্ব- শিক্ষিত নয়।তাছাড়া, তারা তাদের ডিগ্রি,পদ-পদবীকে শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাদের শিক্ষা দেশ ও জাতির কোন কল্যাণেই আসে না। ফিরে আসি মূল আলোচনায়।
বলছিলাম জাতির মেরুদণ্ডের সবলতা ও দূর্বলতা নিয়ে। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে (১৯৯০–২০০০) এদেশে গ্রামে গঞ্জে, নামে -বেনামে মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। যার কারণে পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত দুইটি কলেজের মধ্যে রেজাল্টের অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আর এই একই কারণে পরীক্ষার হলে শুরু হয় অসদ(নকল) উপায় অবলম্বন। পরীক্ষা মানেই ছিল নকলের মহা উৎসব। এভাবে নকলের চারা গাছটি বাড়তে বাড়তে নকলের বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে তা যখন বুঝতে পারা গেল ততদিনে শিক্ষা নামক জাতির মেরুদণ্ড তার সক্রিয়তা হারিয়ে ভঙ্গুরতার দিকে এগিয়েছে অনেক গুন। শিক্ষা সচেতন সব মানুষ আমার সাথে একমত হবেন এমনটি আমি আশা করিনা। তবে সত্য ও বাস্তবতাকে স্বীকার করলে অধিকাংশ শিক্ষা সচেতন মানুষ আমার সাথে একমত হবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
এরপর একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নকলমুক্ত এবং উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চালু করা হয় সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি । নতুন এ পদ্ধতি সবার কাছে অপরিচিত হওয়ায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এমন কি মাঠ পর্যাযের শিক্ষা কর্মকর্তাগণও প্রথম পর্যায়ে এ পদ্ধতি সহজে বুঝে উঠতে পারেননি। যদিও পুনঃ পুনঃ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের কিছুটা দক্ষ করে গড়ে তোলা গেলেও বাধা হযে দাড়াল বারবার কারিকুলাম পরিবর্তন। বারবার কারিকুলাম পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের মনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে যা সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থার উদেশ্য অনেকাংশে ব্যাহত হয়। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় শিক্ষা নামক জাতির এই মেরুদণ্ডের বর্তমান অবস্থা কী?
এবার আসি করোনা কালীন শিক্ষা ব্যবস্থাপনার কথায় । সারা বিশ্বে করোনা বিস্তারের কারণে বাংলাদেশে ২০২০ সালের ১৭ ই মার্চ থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে কারিগরী কমিটির পরামর্শক্রমে কয়েক দফায় ছুটি বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২১ এর আগষ্টে পর্যায়ক্রমিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়।প্রথমদিকে এক একটা শ্রেণির ক্লাস সপ্তাহে এক/দুই দিন হলেও পরে তা নিয়মিত করা হয়। প্রায় দুই বছরের অধিক সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার কি অবস্থা হতে পারে তা সজজেই অনুমেয়। মৃত্য যখন জীবনের দুয়ারে, শিক্ষার বিলাসিতা তখন হাস্যকর। তখন সবার মনে একটাই প্রশ্ন জীবন আগে, না শিক্ষা আগে? নিশ্চয়ই জীবন আগে। তাই, শিক্ষক – শিক্ষার্থী,অভিভাবক সকলের জীবনকে সুরক্ষিত রাখতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে কর্তৃপক্ষ। যা ছিল সময়ের দাবি।
করোনা কালীন শিক্ষা কার্যক্রমকে কিভাবে সচল রাখা যায় তা নিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তা, শিক্ষা গবেষক, শিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা মণ্ত্রনালয় বিভিন্ন পদ্ধতি ও কর্মকৌশল উদ্ভাবন করেন। যাতে করে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ এবং শিখন ঘাটতি কমানো যায়।
যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
★ অনলাইন ক্লাস
★সংসদ টিভিতে ক্লাস
★বাংলাদেশ বেতারে ক্লাস
★ অনলাইন রেডিও তে ক্লাস
★ এ্যাসাইনমেন্ট বিতরণ
★এ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়ন
এছাড়াও কর্মকর্তাদের ম্যাসেন্জারে প্রতিদিন কিছু তথ্য পাঠানোর নিদর্শনা ছিল, যা নিম্নরূপঃ
★কতজন শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশ গ্রহন করে।
★কতজন শিক্ষার্থী সংসদ টিভির ক্লাসে অংশ গ্রহন করে।
★ কতজন শিক্ষার্থী বাংলাদেশ বেতারের ক্লাসে অংশ গ্রহন করে।
★কতজন শিক্ষার্থী অনলাইন রেডিও ক্লাসে অংশ গ্রহন করে
★ কতজন শিক্ষর্থী কোন মাধ্যমেই ক্লাসে অংশ গ্রহন করে না। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন।
করোনা কালীন উপরে উল্লেখিত কাজ গুলো সম্মানিত শিক্ষকদের মাধ্যমেই সম্পাদন হয়েছে। কাজেই একথা বলার অবকাশ নেই যে করোনা কালীন শিক্ষকগন অলস বসে বসে বেতন নিয়েছেন। তাছাড়া এ সময়ে তাদের বেতন হালাল কি হারাম হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন যুক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি না।
মদ্দা কথা হলো শিক্ষকেরা কেউ স্বেচ্ছায় ঘরে বসে থাকেনি। কর্তৃপক্ষ তাদের যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছে তাঁরা তা আন্তরিকতার সাথে পালন করার চেষ্টা করেছেন। এছাড়া যে সব অভিভাবক রাস্তার মোড়ে কিংবা চায়ের দোকানে লম্বা গলায় বলতেন ” শিক্ষকেরা সব পড়ায় নাকি?স্কুলে এসে সব ফ্যানের বাতাসে বসে গল্প করে। করোনা কালীন সেই সমস্ত অভিভাবকই বলেন ” স্যার স্কুল খুলবে কবে? ছেলে/ মেয়ে তো পড়তে বসতেই চায়না। পড়ালেখা সব ভুলে গেছে মনে হয়। যাইহোক করোনা কালীন শিক্ষার্থীদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা অনস্বীকার্য। এ ঘাটতি পূরণে অবশ্যই যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে এবং বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে। তাছাড়া করোনা কালীন গৃহীত বিকল্প পদক্ষেপগুলো যেমনি ক্ষণস্থায়ী তেমনি আপোদ কালীন ব্যবস্হা হিসেবে পরিগনিত। অনেকটা ঝড়ের সময় প্যালা দিয়ে ঘর রক্ষার নামান্তর।
যদিও অনেকেই মনে করেন আরও কিছু দিন আগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেত। প্রতিটি বেঞ্চে একজন করে বসে, একটি শ্রেণি সপ্তাহে ১/২ দিন বিদ্যালয়ে আসলে তাতে শিক্ষক -শিক্ষার্থীদের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে অসুবিধা হতো না। এগুলো মানুষের মনের ধারণামাত্র।তবে এ ধারণা একেবারে অমূলক তা বলার কোন সুযোগ নেই । কারণ সভা -সেমিনার, হাট-বাজার, মিছিল -মিটিং, নির্বাচন,যানবাহন, বিয়ে সহ অনান্য সামাজিক অনুষ্ঠান যেখানে স্বাভাবিক নিয়মে চলমান সেখানে কেবলমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তবুও বলব, সরকার যে সিদ্ধান্তই নিয়েছে তা করোনা বিষয়ক কারিগরি ও পরামর্শক কমিটি এবং শিক্ষা বিষয়ক গবেষকদের পরামর্শ নিয়েই নিয়েছেন ।
পাঠকের ধৈর্যের চ্যুতি না ঘটিয়ে আর কয়েকটি প্রয়োজনীয় কথা লিখে ইতি টানব। করোনা পরবর্তী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ কিছু নির্দেশনা জারি করেন। যার বেশির ভাগই ছিল স্বাস্থ্য সচেতনতা মূলক এবং শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতিপূরণ সংক্রান্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রি-ওপেনিং এর প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটা শ্রেণি সপ্তাহে ১/২দিন করে আসলেও পরে স্বভাবিক হয়ে আসে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কিছু দিনের মাথায় শুরু হলো পবিত্র মাহে রমজান। শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণের জন্য রমজানের ছুটি কমিয়ে ২০রমজান পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। যা অনেকের কাছে অপছন্দের হলেও আমার মত অনেকেরই প্রশংসা কুড়িয়েছে।শিক্ষার্থীরা যেমন রোজা রেখে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ গ্রহন করেছে শিক্ষকেরাও তেমনি রোজা রেখে শিক্ষার্থীদের পাঠ দানে সক্রিয় ছিলেন। সবই ছিল শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণের জন্য। তাছাড়া বহুদিন পর বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে শ্রেণি কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বলে আমি মনে করি। রমজানের শেষে আবার ও দীর্ঘ ১৯ দিনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদুল ফিতরের ছুটির ঘোষণা দেওয়া হয়।
ঈদের ছুটি শেষে শিক্ষার্থীরা আবার ফিরল শ্রেণি কার্যক্রমে। কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্য যে শুরুতেই শ্রেণি কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হলো। শুরু হলো আন্তঃ প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা -২০২২ কার্যক্রম। এরপর রয়েছে স্টুডেন্টস কাউন্সিল নির্বাচন এবং বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট২০২২ ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট ২০২২। করোনা পরবর্তী এ সকল সহ শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণ অনেকাংশে ব্যাহত হবে। তাছাড়া শিখন ঘাটতি পূরণের জন্য যেখানে ছুটি সমন্বয় করা হচ্ছে, রুটিনে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে সেখানে এ জাতীয় কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে সময়ের অপচয় কতটুকু যুক্তিসংগত কর্তৃপক্ষ তা একবার ভেবে দেখবেন বলে আশা করি। বিষয়টা যেন এমন ” ঘরে বেড়া নেই,দেউড়িতে পর্দা টাঙানোর প্রতিযোগিতা। যা হোক শেষান্তে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন ও যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণ হোক,জাতি তার মেরুদণ্ড শক্ত করে দেশের কাঙ্খিত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করুক এই প্রত্যাশা করি।