ছড়াকার ফরিদ সাইদ এর তিনটি বই ও তার কাব্যিক জগত
– মুহাম্মদ ইসমাঈল
শিল্পমধুর শব্দের ব্যঞ্জনায় জীবনের গভীর বোধ থেকে যখন উঠে আসে কবিতা বা ছড়া তখন শব্দের সারল্যের মতো প্রতিটি শব্দ ভেসে বেড়ায় অবোধ মন। যা সাধারণ পাঠক হৃদয়ে নৈঃশব্দে ঝংকার তুলতে সক্ষম। শব্দকে অতিরঞ্জিত না করেও যে তরল সুর প্রবাহিত করে গেছেন ছড়াকার তার তিনটি ছড়া গ্রন্থে।
বলছি ফরিদ সাইদের কথা। নব্বই দশকের কবি ও ছড়াকার। ছড়া কবিতার খ্যাতি তার দীর্ঘদিনের। লেখালেখিতে অভিষেক ১৯৮৭ সালে। সাইয়্যেদ আতিক নকীব ভাইয়ের হাত ধরে দৈনিক মিল্লাতে। কিছুদিন সংসারের হাল ধরতে যেয়ে লেখালেখি বন্ধই ছিল। এটা অবশ্য বেশি দিন ছিল না। তিনি আবার শুরু করেছেনে নব উদ্যমে। লিখে চলেছেন জাতীয় দৈনিকে, সাপ্তাহিকে, মাসিক পত্রিকাগুলোতে। পত্রিকার পাতা উল্টোতেই এখন বেশির ভাগ দেখি ফরিদ সাইদ এর লেখা।
ফরিদ সাইদ এর প্রথম ছড়াগ্রন্থটির নাম “হাত বাড়ালেই ঝরনা”- প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে বই মেলাতে।
এই গ্রন্থটিতে ছড়াকার ৬৪টি ছড়ার স্থান দিয়েছেন। যেমন ছড়াকার মাকে নিয়ে একটি ছড়া লিখেছেন এখানে ছড়াটির কিছু অংশ দেওয়া হল-
“হয়তো আমার মা জননী
আমায় ডাকে আয়
মা আমাকে কাছে পেতে
কাঁদে নিরালায়।
ছড়াকার জন্মভ‚মিকেও ভুলেননি। জন্মভ‚মিকে নিয়ে তার একটি ছড়ার ক্রিয়দাংশ-
“এই আমাদের জন্মভ‚মি
সবাই জেনে নিও
বীর শহীদদের পূণ্যভ‚মি
প্রাণের চেয়ে প্রিয়”
ফরিদ সাইদ পরিচ্ছন্নমনের মানুষ। তার লেখায় কঠিন ভাব নেই। কঠিন শব্দ নেই। কঠিন চিত্রপঠ নেই। শিশু-কিশোরসহ সকল মহলের জন্য বোধগম্য ভাষাই তিনি লিখে চলেছেন “দাগ রেখে যাই” তার দ্বিতীয় ছড়াকাব্যগ্রন্থ।
সমাজের নানা বিষয়ে এতে উঠে এসেছে অতি সুন্দরভাবে। প্রগতিশীল এই ছড়াকার সাহিত্য অঙ্গনে দাগ রেখে যেতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস। এই গ্রন্থটি বইমেলা ২০১৯ এ প্রকাশিত হয়েছে। এখানে ৪২টি কবিতার স্থান পেয়েছে। যেমন “দাগ রেখে যাই” কবিতায় কবি লিখেছেন:-
“সবার নিয়ম-নীতি আছে
এ জগত-সংসারে
চারিদিকে নানান কিছু
মানুষের দরকারে।
কর্ম করেন ভেবে চিন্তে
বিশ্বে সকলজনে
ভালো-মন্দ কোনটা সঠিক
ভাবি মনে মনে।
যেমন ঘুষ নিয়ে সমাজের নানা অসঙ্গতির কথা নিয়ে তুলে ধরেছেন-
কথা-কাজে মিল নেই
তিনি এক অফিসার
নিরবে করেন বসে
বেহালালী কারবার
ঘুষকে বলেন তিনি
এটা তার অধিকার
ফাইল ছেড়ে রোজ রোজ
হাতে তুলে উপহার।”
ছড়াকার ফরিদ সাইদ এর তৃতীয় ছড়াগ্রন্থ “ফিরে চল আপন দেশে” প্রকাশিত হয় বইমেলা ২০২১ এ। এখানে স্থান পেয়েছে ৫৫টি ছড়া কবিতা।
এ পৃথিবী থাকার জায়গা না। ছড়াকার “ও মন ফিরে চল আপন দেশে” কিভাবে আখেরাতকে পাওয়া যায়, কিভাবে মানুষ মানুষের মত হয়ে পরকালে যাওয়া যায় সেটি তিনি তার কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
“মায়ের গর্ভ থেকে যখন এলাম দুনিয়াতে
ছোট-বড় বাড়ির সবাই খুশি হলেন তাতে
তুলতুলে ত্বক হাত-পা নরম কোমল মুখের হাসি
আমায় নিয়ে পিতামাতার স্বপন রাশি রাশি।
“হঠাৎ জানি দেহের থেকে বেরিয়ে যাবে জান
দুর্ভাবনায় দিবানিশি মন করে রে আনচান।
হাসি-তামাশার রঙ্গমালা চিরস্থায়ী না
থাকতে সময় চিনে নে মন আপন ঠিকানা।
ছড়াকার এই গ্রন্থের আরেকটি ছড়া কবিতায় লিখেছেন “কার খেয়ালে” শিরোনামে-
“কার খেয়ালে বিশ্বজগৎ
চাঁদ-সুরুজের আলো
নজরকাড়া ঝরনাধারা
সবই লাগে ভালো।
কার খেয়ালে সাগর নদী
ভরা নানান মাছে
উঁচু উঁচু পাহাড়গুলো
ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
কার খেয়ালে রাতের ভিতর
দিনের আলো আসে
খুঁটি বিহীন নীল আকাশে
মেঘের ভেলা ভাসে। ”
ছড়াকার ফরিদ সাইদ এর জন্ম ঢাকার নবাবগঞ্জের জয়কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের চিরায়ত সবুজের সমারোহে ১৯৭৮ সালের ৩০ শে জুলাই। পিতা রজব খান, মাতা লুৎফুন নেছার বড় সন্তান। স্ত্রী নীলা রহমান, ছেলে ফাহিম খান, মেয়ে ফারিন খানকে নিয়ে সুখের সংসার। ফরিদ সাইদ এর একমাত্র কন্যাও ছড়া কবিতা লেখেন। ইতোমধ্যে তার বেশ কয়েকটি ছড়া বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ফরিদ সাইদ বর্তমানে থাকে ৮৪/২ রহমতপুর, মাতুয়াইল, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
তিনি শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজে লেখাপড়া করেন। স্কুল জীবন থেকে লেখালেখি শুরু। তার প্রথম লেখা ১৯৮৭ সালে জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়। ১৯৮৭ সালের ২১শে ফেব্রæয়ারী উপলক্ষে স্কুল পর্যায়ে স্বরচিত কবিতায় জাতীয় যাদুঘর থেকে প্রথম পুরস্কার অর্জন করেন।
তিনি আবাবিল সাহিত্য সম্মাননা, ছড়া-সাহিত্যে ফ্রেন্ড সার্কেল সাহিত্য সম্মাননা, আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংগঠন নন্দীনি সাহিত্য ও পাঠচক্র এর বার্ষিক সম্মেলনে প্রতিযোগিতামূলক স্বরচিত কবিতায় দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। সৃজনশীল সাহিত্য সংগঠন “গানের কবি প্রাণের কবি নজরুল” এর সভাপতি, নন্দীনি সাহিত্য ও পাঠ চক্রের অর্থ সম্পাদক, বাংলাদেশ লেখক সমিতি, নজরুল একাডেমি, ভাষা আন্দোলন স্মৃতি রক্ষা পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন।
উপরেল্লিখত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, ছড়াকার তার তিনটি ছড়াগ্রন্থে দুনিয়া আখেরাতের কথা, দেশ মাতৃকা ও প্রকৃতি নিয়ে যা লিখেছেন প্রত্যেকটি ছড়াই সুখপাঠ্য। প্রত্যেকটি ছড়া কবিতার পরতে পরতে যে অনুভ‚তি যে দাবীর কথা তুলে ধরেছেন তা পাঠক হৃদয়ে প্রভাবিত করবে। ছড়ার আত্মমগ্ন থাকার নিত্য নতুন অভিপ্রায় জাগাবে সেই প্রদ্যোত প্রত্যাশা।