বাংলাদেশ ভূমির বিশেষ সাক্ষাৎকার পর্বে আজকের অতিথি কবি রফিকুল্লাহ কালবী। তিনি সাহিত্যের শ্বাপদসংকুল পথে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন কয়েক দশকধরে। আমরা তার এই পথচলার গল্পটি জানতে চাই এবং জানাতে চাই বাংলাদেশ ভূমির পাঠকদেরকেও। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইন।
খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইনঃ আচ্ছালামু আলাইকুম। কেমন আছেন কবি?
রফিকুল্লাহ কালবীঃ ওয়া আলাইকুমুসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি। আপনাকে ও বাংলাদেশ ভূমির বিদগ্ধ পাঠকদের জন্য ভালোবাসা।
খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইনঃ সাহিত্য চর্চা করছেন বহুবছর ধরে। সাহিত্যের কোন্ শাখায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? এবং কতটুকু কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন।
রফিকুল্লাহ কালবীঃ হ্যাঁ, বহুবছর ধরে অল্পবিস্তর কাজ করেছি। যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তাম তখন থেকেই ছড়া যাতীয় কিছু একটা বানানোর চেষ্টা করতাম। অন্তমিল দিয়ে যা তা কিছু লিখে সহপাঠীদের পড়ে শুনাতাম, ওরা খুব মজা পেতো- এ নিয়ে হৈচৈ করতো- তখন আমিও খুব আনন্দ পেতাম এবং আরও বেশি বেশি লেখার চেষ্টা করতাম। অল্পদিনের মধ্যেই স্কুলের ছাত্র শিক্ষক সকলেই আমাকে কবি বলে ডাকতো। তখন মনে হতো সত্যি সত্যিই কি কবি হওয়া সম্ভব! পাঠ্য বইয়ের কবিতাগুলো খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। মূলত এভাবেই গোপনে গোপনে কবিতার প্রতি প্রেম জমে ওঠে। ছোটবেলার কোন লেখা এখন আর সংগ্রহে নেই। তবে এটা বুঝি যে, ঐ লেখাগুলো মোটেও কোন মানোত্তীর্ণ লেখা ছিলো না।
ছড়া ও কবিতা লেখার প্রতিই আমার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। এযাবৎ প্রায় তিন হাজারের বেশি কবিতা ও ছড়া লিখেছি- যা আমার সংগ্রহে আছে। তবে আমি প্রবন্ধ এবং ছোটগল্পও লিখেছি অনেক।
খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইনঃ কবিতার প্রতি অনুরাগের পেছনের গল্পটি যদি শোনাতেন।
রফিকুল্লাহ কালবীঃ আমার মনে হয় কবিতার প্রতি অনুরাগের পেছনের গল্পটি আমি আগের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলে ফেলেছি। আসলে কবিতা আমার জীবন বৃক্ষের শেকড়ের মতো, এই শেকড় দিয়ে আমি মাটি থেকে রস সিঞ্চন করে বেঁচে থাকি। কবিতা ও ছড়া হলো সাহিত্যের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম শাখা। বহু সময় ব্যয় করে একটি গল্প, একটি নাটক, একটি উপন্যাস পড়ে আমি মানব জীবনের একটি পর্যায় সম্পর্কে জানতে পারি। অথচ সেই একই ঘটনা কয়েক লাইন কবিতার মধ্যে অনায়াসে আবদ্ধ করা সম্ভব। পুরো ঘটনাপ্রবাহ অতি অল্প সময়ে পড়ে হৃদয়ঙ্গম করা যায়। ছড়া ও কবিতা সাহিত্যের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম শাখা হলেও এর ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি হয় সবচেয়ে শক্তিশালী। তাই আমি শিশুকাল থেকেই কবিতা ও ছড়ার প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠি।
খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইনঃ এই পথ চলায় নিজেকে মেলে ধরার পথে সব চেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত হয়েছেন কোথায়। পরিবারের সকলেই কি ভালো ভাবে গ্রহণ করেছেন?
রফিকুল্লাহ কালবীঃ না, সাহিত্যের পথে আমি কখনও বাধাগ্রস্ত হইনি। ছোটবেলায় সহপাঠী ও শিক্ষকগণ উৎসাহ যোগাতেন, এখন আরও বেশি মানুষ উদ্দীপনা দেয়। পরিবার আমাকে সব সময়ই সাপোর্ট দিয়েছে। স্বৈরাচার মাফিয়া সরকারের বিরুদ্ধে যখন সমানে কবিতা, ছড়া ও প্রবন্ধ লিখে তাদের মুখোশ জাতির সামনে উন্মোচিত করেছি তখনও আমার পরিবার আমাকে সাহস দিয়েছে। আমার পরিবার, আত্মীয় পরিজন সকলেই আমার লেখা উপভোগ করেন। সেই হিসেবে আমাকে ভাগ্যবান বলতে পারেন।
খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইনঃ আধুনিক কবিতায় লক্ষ্য করা যায়, কবিতা অন্তমিলকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ ব্যপারে আপনার অভিমত কি?
রফিকুল্লাহ কালবীঃ অন্তমিলের কবিতাও কবিতা, আবার গদ্য কবিতাও কবিতা। রবীন্দ্রনাথসহ অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত কবিই এই দুই ধরণের কবিতাই লিখেছেন। তবে গদ্য কবিতা তিনিই ভালো লিখতে পারেন যিনি ছড়া ও ছন্দ কবিতা লিখতে সিদ্ধহস্ত। অর্থাৎ ছড়া ও ছন্দ কবিতায় কতিপয় নিয়ম মানা হয়, কিন্তু গদ্য কবিতায় নিয়ম ভাঙ্গা হয়। যিনি ছড়া ও কবিতায় যতবেশি নিয়ম মেনে চলবেন তিনি গদ্য কবিতায় গিয়ে ততো সুন্দর করে নিয়ম ভাঙতে পারবেন। একটি উদাহরণ দিই- যে অভিনেতা মঞ্চ অভিনয়ে যতবেশি পাকা তিনি টেলিভিশন নাটক ও সিনেমায় ততোবেশি পাকা অভিনেতা হিসেবে বিবেচিত হন। ছড়া ও ছন্দ কবিতা হলো মঞ্চ অভিনেতার মতো পাকা ও দক্ষ হাত। আর এই পাকা হাতের লোকগুলোই কেবল পাকা পাকা গদ্য কবিতার জন্ম দিতে পারে।
খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইনঃ স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় কাজ করার বিস্তর সুযোগও এসেছে বলা যায়। এই কারণে সুযোগ বলবো, ফ্যাসিবাদের বিপরীত আদর্শের মানুষ আপনি। তখনকার দিনে সাইবার সিকিউরিটি এ্যাক্টের খড়্গ ঝুলছিল। যখন তখন মামলা মকদ্দমার আতঙ্ক ছিলো। এখন তা নাই। সাহিত্য চর্চার বিরাট সুযোগ এসেছে বলতে পারেন। কিভাবে সুযোগটিকে কাজে লাগাতে চান?
রফিকুল্লাহ কালবীঃ স্বৈরাচারের পতনে সাহিত্য চর্চার সুযোগ এসেছে অথবা সুযোগ আসেনি- আমার কাছে এমনটি মনে হয় না। লেখক যে কোন পরিবেশ ও পরিস্থিতিকেই তার লেখার উপকরণ বানায়। পরিস্থিতি যত বৈরি হয় কাজী নজরুলের কলম ততো খড়গ কৃপাণ হয়ে ওঠে। দারিদ্র্যের অমোঘ পরিহাস কবিকে খ্রীষ্টের সম্মান দান করে। আমাদের নজরুল যদি হাজারো মুসিবতের আগুনে না পুড়তেন তাহলে তিনি এতো বড় মাপের সাহিত্যিক হতেন কি না তা নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে। স্বৈরাচার মাফিয়ার আমলে আমি যেভাবে সরকারের বিরুদ্ধে সাহিত্য রচনা করেছি এখন আর অতোটা লেখা হয়ে ওঠে না। আমি বলতে চাই, প্রতিটি পরিস্থিতিই লেখকের জন্য অনুকূল। বরং বৈরি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে লেখকের কলম অধিকতর ধারালো হয়ে উঠবে। এখন স্বৈরাচার তিরোহিত হয়েছে, আমরা আর কোন স্বৈরাচার মাফিয়া সরকার চাই না এবং জীবনের সর্বোচ্চ কুরবানির বিনিময়ে আমরা স্বৈরাচারকে প্রতিহত করবো। কিন্তু এই জাতির কপালে যদি দুর্ভোগ থাকে তাহলে নতুন কোন মাফিয়া নতুন রুপে জাতির উপর চেপে বসতে পারে। তাই সকল পরিস্থিতিতে লেখকদের সোচ্চার ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। লেখকরা স্বাভাবিকভাবেই দূরদর্শী হন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদেরকে আরও বেশি বিচক্ষণ ভূমিকা পালন করে যেতে হবে।
খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইনঃ আসন্ন অমর একুশে বইমেলায় আপনার কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা আছে কিনা?
রফিকুল্লাহ কালবীঃ একুশে বইমেলায় একটি ছড়া, একটি কবিতা ও একটি গল্পের বই প্রকাশের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি, দেখা যাক কী হয়। আপনাদের দোয়া চাই।
খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইনঃ তরুণ প্রজন্মের প্রতি আপনার পরামর্শ ও উপদেশ কি?
রফিকুল্লাহ কালবীঃ তরুনরা সাহিত্য নির্ভর বই পড়লে তাদের ভাষাজ্ঞান বৃদ্ধি পাবে। তখন তাদের মধ্যে লেখালেখি করার একটি মানসিকতাও তৈরি হবে। মোবাইল নির্ভরতা কমিয়ে দিয়ে তরুনরা বই পড়ায় মনোনিবেশ করুক- এটাই চাই।
বাংলাদেশ ভূমি একটি মননশীল সাহিত্য পত্রিকা। আমি এই পত্রিকার সাফল্য কামনা করি। এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে আমার শুভেচ্ছা।
খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইনঃ বাংলাদেশ ভূমিকে সময় দেবার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।