আমার আহমদ বাসির ভাই
হারুন আল রাশিদ
সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততা শেষে বাসায় ফিরলাম। ফ্রি হয়ে ফেসবুকে ঢুকলাম। নিউজফিড স্ক্রল করছি। কবি জানে আলমের একটা স্ট্যাটাস চোখে পড়তেই চমকে উঠলাম। ছ্যাঁৎ করে উঠলো বুকের ভেতরটা। ও আল্লাহ্! এ আমি কি পড়ছি। ‘কবি আহমদ বাসির আল্লাহর কাছে চলে গেছেন।’
কমেন্ট বক্সে ঢুঁ মারলাম। কারা কারা কমেন্ট করেছে। কবি রেদওয়ানুল হক ভাইর কমেন্ট দেখেই তার প্রোফাইলে গেলাম। উদ্দেশ্য, আরও বিস্তারিত জানতে পারবো। রেদওয়ান ভাইর সাথে বাসির ভাইর অসম্ভব ভালো সম্পর্কের কথা সবারই জানা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেক কিছু জানতে পারলাম। যদিও জানার পরিমাণ অপূর্ণাঙ্গ। জানে আলম ভাইর ইনবক্সে নক করলাম। রিপ্লে আসলো, এখনো পুরোপুরি জানতে পারিনি। ভাবলাম, জেনে আর কি হবে! যখন বাসির ভাইকে ফিরিয়ে দেয়া পৃথিবীর ছয়’শ কোটি মানুষের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।
এবার ডুব দিলাম নিজের ভেতরে। ফেলে আসা স্মৃতির অথৈ মহাসাগরে। ২০০১ সালের কথা। বাংলা সাহিত্য পরিষদের মাসিক সাহিত্য সভা চলছে। একাধিক আলোচকের মধ্যে আহমদ বাসির ছিলেন একজন। পঠিত লেখার ওপর আলোচনা জমে উঠেছে। একসময় ডাকা হলো আহমদ বাসিরকে। ডায়াসে দাঁড়িয়ে কথা শুরু করলেন। পেছন থেকে একজন বলে উঠলো, কথা শোনা যাচ্ছে না। বাসির ভাই কন্ঠ ভলিউম প্রায় চারগুণ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এবার কি শুনতে আগের মতোই কষ্ট হচ্ছে? একজন বলে উঠলো, কষ্টটা বেড়ে গেছে। সাউণ্ড অর্ধেক করেন। অনেকেই হেসে উঠলো। যার সাথে আমারও অংশগ্রহণ ছিলো। এই প্রথম বাসির ভাইকে দেখলাম। চিনলাম। সাহিত্য সভা শেষ হতেই আলাদা একটা প্রোগ্রামের লিফলেট বিতরণ করতে শুরু করলেন। আমার কাছাকাছি আসতেই বলিষ্ঠ বিনয়ী কন্ঠে বললেন, হারুন! সময় করতে পারলে আসবা। তুমি করে বললাম। কিছু মনে করো না। বয়সে আমার ছোটই হবা।
চেহারায় চলনে প্রতিভার ঝিলিক। কিছু মানুষের মুখাবয়ব অকপটে বলে দেয় তার পাণ্ডিত্যের ক্ষিপ্রতা। অসম্ভব প্রতিভাবান একজন তরুণ। সমসাময়িক পৃথিবীর ওপর ছিলো ঈর্ষণীয় দখল। বিভিন্ন বিষয়ে ছিলেন পারঙ্গম। তারুণ্যের টকবগানো লেগে থাকতো আচরণে। জড়তাহীন দ্রুত কথা বলতেন। স্পষ্ট উচ্চারণে। একবার কবি মৃধা আলাউদ্দিনের ছেলের সুন্নাতে খ্যাৎনা অনুষ্ঠানে পাশাপাশি বসে খাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। কবি নাজমুস সায়াদাতের সাথে বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হচ্ছিল। গুরুগম্ভীর বাক্য উদগীরণের এক পর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হারুন কি আমাদের কথা বুঝতে পারতেছো? নাজমুস সায়াদাত ভাই বললেন, হারুন ভাই ক্রিটিকাল মানুষ। অবশ্যই বুঝতে পারতেছে।
এক সন্ধ্যায় মাসিক ফুলকুঁড়িতে লেখা দিতে গেলাম। দেখা হয়ে গেলো। সাত-আটটা রাজনৈতিক ছড়া সাথে ছিলো। এগিয়ে দিলাম। বেশ ধৈর্য নিয়ে পড়লেন। পাঠান্তে বললেন, চেহারায় তো মনে হয় একেবারেই ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ। ভালোই তো রাজনৈতিক ছড়া লেখো। চালিয়ে যাও। বাজিমাত করতে পারবা।
গত আগষ্টে কয়েকবার কথা হয়েছে ফোনে। আমার তখন ছুটি চলছে। প্রবাস জীবনে বছরে দুইবার ছুটি পাই আমরা। আগষ্ট ও ডিসেম্বরে। ছুটির পরিমাণ বেশি থাকে আগষ্টে। সময়টাকে ভালোভাবেই কাজে লাগাই আমি। প্রচুর লেখালেখি করি। লেখা এডিট করি। অন্য মাসের খরা সুদে-আসলে পুষিয়ে নেই। প্রিয়জনদের সাথে সময় নিয়ে মন খুলে কথা বলি। বাসির ভাইর সাথে গান নিয়ে অনেক কথা হয়। গানের ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন। বললেন, কয়েকদিন আগে ফেসবুকে মা’কে নিয়ে তোমার একটা লেখা গান চোখে পড়লো। খুব পছন্দ হলো। গানটা আমরা করবো। পরিকল্পনায় থাকলো।
এরপর কথা হয়নি অনেকদিন। এভাবেই এগিয়ে গেলো সময়। পেলাম অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর খবর। আমার লেখা মা’কে নিয়ে গানটা গাওয়ার পরিকল্পনা মহাকালের ফিতায় আটকে থাকলো। বাসির ভাই! আমি মা হারা সন্তান। মায়ের শূন্যতা অনুভব করি সর্বক্ষণ। আপনার মা কিন্তু সন্তান হারা হয়ে গেলো। আমাকে স্বান্ত্বনা দিয়েছে আমার চারপাশের স্বজনেরা। আমি শান্ত হয়েছি। থামিয়েছি হৃদয় উথলানো কান্নার আওয়াজ। আপনার মা’কে স্বান্ত্বনা দেয়ার স্বজন দুনিয়া পইপই করেও খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। মায়ের কলিজা থেকে সন্তান হারানোর বেদনা অপসারণ করার ক্ষমতা আজীবন সাধ্যের বাইরেই থেকে যাবে। আল্লাহ গো! দুখিনী মা’কে তুমি ভালো রেখো। তোমার সান্নিধ্যে সম্মানিত মেহমান করে রেখো আমার বাসির ভাইকে।