দেয়ালের ওপাশে কে
শামীমা আক্তার
হাবিব ও রেশমা দম্পতির একমাত্র মেয়ে হলো কথা। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো মেয়েটি অটিস্টিক বা স্পেশাল চাইল্ড। কথার যখন ২ বছর বয়স, তখন হাবিব ও রেশমা দম্পতি বুঝতে পারেন তাদের মেয়েটি আর দশটা বাচ্চার মতো স্বাভাবিক না। কথার মুখে কোনো শব্দ নেই! কথা, কথা বলতে পারেনা! রেশমা কথার মুখে মা ডাক শুনার জন্য ব্যাকুল। কিন্তু কথা রেশমাকে মা বলে ডাকতে পারেনা! তখন তারা কথাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার বলে যে তাদের মেয়েটি অটিস্টিক শিশু! এই কথা শোনার পর হাবিব ও রেশমা দম্পতির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।
এই কথা শুনে তারা দুজন খুব ভেঙে পড়লো। অনেক কান্নাকাটি করলো। এরপর দিন যায়, কথা বড় হতে থাকে। তাদের আত্মীয় স্বজন এবং প্রতিবেশীরাও এক সময় বুঝতে পারে যে কথা অটিস্টিক শিশু। তখন তারা স্বান্তনা দেওয়ার বদলে হাবিব ও রেশমা দম্পতিকে নানান ধরনের কটুকথা শোনাতে লাগলো। কেউ কেউ বলল, এই শিশু তাদের কোনো পাপের ফল! কেউ কেউ বলল, এটা একটা বোঝা। এমন বাচ্চা থাকার চেয়ে না থাকা ভাল।
কেউ কেউ বলল, এই বাচ্চা মরলে তোমরা বেঁচে যেতে। সবার এসব কথা শুনে হাবিব ও রেশমা দম্পতি অনেক কষ্ট পেতো। চোখের জলে বুক ভাসাতো। তারা সিদ্ধান্ত নিলো চেনা পরিবেশ ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবে তারা তাদের মেয়েকে নিয়ে। তারপর তারা একদিন তাদের মেয়েকে নিয়ে অনেক দূরে চলে গেলো। সেখানে তারা কথাকে একটি ঘরে তালা মেরে রাখতো। যখন খাবার সময় হতো, রেশমা তার মেয়েকে খাওয়াতো, গোসল করাতো, মেয়ের সব কাজ করে দিতো। কারণ কথা কিছুই করতে পারতো না। একদিন পাশের বাসার এক ভদ্র মহিলা হাবিব ও রেশমা দম্পতির বাসায় এলেন। রেশমার সাথে অনেক গল্প করলেন তিনি। ভদ্র মহিলা পেশায় একজন ডাক্তার। ভদ্র মহিলা রেশমাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনাদের কোনো বেবি নেই? রেশমা তখন ইতস্তত করে বলল না । আমরা এখনো নিঃস্বন্তান। চা, নাস্তা খেয়ে, গল্প করে ভদ্র মহিলা সেদিন চলে গেলেন। আরেকদিন ভদ্র মহিলা এলেন রেশমাদের বাসায়। তখন কথার খাবার সময়। ভদ্র মহিলাকে ড্রইং রুমে বসিয়ে রেখে রেশমা কথাকে খাবার খাওয়ানোর জন্য গেলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ভদ্র মহিলা ভিতরের রুমে গেলেন। গিয়ে খুব অবাক হলেন! তিনি দেখলেন রেশমা ৬ বছরের ছোট্ট একটি মেয়েকে মুখে তুলে খাবার খাওয়াচ্ছেন। ভদ্র মহিলা কৌতুহল চেপে রাখতে পারলেন না। তিনি বলে উঠলেন মেয়েটি কে আপা? রেশমা চমকে পিছন ফিরে তাকালো, তারপর অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো।
ভদ্র মহিলা রেশমার কাছে এগিয়ে গেলেন, তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, কি হয়েছে আপা? আমাকে সবকিছু খুলে বলতে পারেন। কোনো সমস্যা নেই। রেশমা তখন বলল, এটা আমার মেয়ে। ও অটিস্টিক শিশু। আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু বান্ধব ও পাড়া প্রতিবেশীর কটুকথা সহ্য করতে না পেরে ওকে নিয়ে সবার কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি, এতো দূরে। সবার অগোচরে মেয়েটিকে নিয়ে এখানে বাস করছি আমরা। কারো কটু কথা যাতে শুনতে না হয়, তাই আমরা আমাদের এই বাচ্চা মেয়েটিকে এই ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখি। কাউকে বুঝতে দেই না যে আমাদের একটি অটিস্টিক শিশু আছে। রেশমার কথা শুনে ভদ্র মহিলার চোখে জল চলে এলো। ভদ্র মহিলা বললেন, আপনি ওকে এভাবে ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখে ওর প্রতি ভীষণ অন্যয় করছেন৷ আপনি ওকে বাইরে বের করে নিয়ে আসুন। ওকে স্পেশাল শিশুদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিন। তখন দেখবেন কথার অনেক ইম্প্রুভ হবে। তারপর ভদ্র মহিলা নিজে কথাকে স্পেশাল শিশুদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। কথা এখন পড়তে পারে। লিখতে পারে। অনেক সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। কথার আঁকা ছবি জাতীয় পর্যায়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম বিজয়ী হয় এবং পুরষ্কার হিসেবে কথাকে মেডেল দেওয়া হয়। কথাকে এখন সবাই চিনে। সে এখন আর বন্ধ ঘরের বাসিন্দা না। খাঁচায় বন্দী পাখি না। সে এখন মুক্ত আকাশে ডানা মেলা পাখি। সে এখন মুক্ত বিহঙ্গ।