ইসলামোফোবিয়া
এ্যাডভোকেট মোঃ রেজাউল ইসলাম
ইসলাম শব্দটি(س-ل-م) সিল্ (সি-ল্-ম) শব্দমূল হতে গঠিত, (বাবে এফআল) এর মাসদার (ক্রিয়ামূল)। ব্যুৎপত্তিগতভাবে সাল্-ম (س-ل-م) এর কয়েকটি অর্থ হলঃ বাহ্য ও আভ্যন্তরীণ উভয়বিধ অপবিত্রতা (বিপদ-আপদ) ও দোষ-ক্রুটি হইতে মুক্ত (পবিত্র) থাকা, সন্ধি ও নিরাপত্তা, শান্তি ও আনুগত্য ও হুকুম পালন, আত্মসমর্পণ করা, কল্যাণ লাভ করা।
পবিত্র কুরানের ৮ জায়গায় ইসলাম শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে (৩:১৯, ৮৫; ৫:৩; ৬: ১২৫, ৯:৭৮; ৩৯:২২; ৪৯:১৭; ৬১:৭)। স্বরচিহ্নের তারতম্যের কারণে বিভিন্ন আকারে তবে একই অর্থে এই শব্দমূল থেকে উৎপন্ন বেশ কয়েকটি পদের ব্যবহার দেখা যায়। (৮:৬১) যুদ্ধবিরতির জন্য শান্তির প্রস্তাব, (২:১০৮) ইসলামী বিধান, (৪:৯১-৯২) যুদ্ধ পরিহারের প্রস্তাব, (১০:২৫) শান্তি বা (৫১:২৫) শান্তি কামনামূলক মুসলিম অভিবাদন। শেষোক্ত অর্থে ২৪:২৭ আয়াতে, ইসলাম শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সালাম ও সাল্-ম উভয় শব্দেরই অর্থ হল আনুগত্য, আত্মসমর্পণ ও হুকুম পালন। অর্থগুলোর মধ্যে “পবিত্র ও দোষ-ক্রুটিমুক্ত হওয়া” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই শব্দমূল হতে (ক্রিয়াপদে)(أَسْلَمَ) আসলামা, ইসলাম গ্রহণ করল ও ক্রিয়া বিশেষ্য (إِسْلَام) ইসলাম, আত্মসমর্পণ এবং কর্তৃকারকে (مسلم) মুসলিম, ইসলাম গ্রহণকারী শব্দ তিনটির উৎপত্তি হয়েছে। ইসলাম (আরবি: আল-ইসলাম-الإسلامالإسلامالإسلام একটি একেশ্বরবাদী এবং ইব্রাহিমীয় ধর্মবিশ্বাস যার মূল শিক্ষা হল, এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন স্রষ্টা নেই এবং মুহাম্মদ হলেন আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ ও চূড়ান্ত নবি ও রাসূল।
মানবজাতিকে পথ প্রদর্শনের জন্য তিনি যুগে-যুগে অনেক নবি-রাসূল, আসমানী কিতাব এবং নিদর্শন পাঠিয়েছেন। ইসলামে প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো পবিত্র কুরআন, যা স্বয়ং আল্লাহর বানী; আর সর্বশেষ ও চূড়ান্ত নবী মুহাম্মদ (ﷺ) (২৯ আগস্ট ৫৭০- ৮ জুন ৬৩২) এর কথা, কাজ ও মৌন সম্মতিকে সুন্নাহ বলা হয়। ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী ইসলাম শুধুমাত্র কোন নতুন ধর্মই নয়, বরং সৃষ্টির শুরু থেকেই ইসলামের উৎপত্তি। হযরত আদম (আঃ) ছিলেন এই পৃথিবীর প্রথম মানব এবং মানবজাতীর মধ্যে ইসলামের প্রথম নবী। আর সর্বশেষ ও চূড়ান্ত নবী হলেন মুহাম্মদ (সাঃ), যিনি সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য আবির্ভূত হয়েছেন ¯স্রষ্টার পক্ষ থেকে। ইসলামী ধর্মমত অনুযায়ী, যুগে যুগে আদম(আঃ), ইব্রাহিম(আঃ), মুসা(আঃ), ইসা (আঃ) সহ সকল রাসূলগণের উপর যেসব আসমানী কিতাব অবতীর্ন হয়েছিল, মূল আরভি ভাষার কুরআন হল তারই সর্বশেষ, পূর্ণাঙ্গ, অপরিবর্তিত ও চূড়ান্ত সংস্করণ। ৬৩২ খিস্টাব্দে বিদায় হজ্জের দিন এই জীবন ব্যবস্থাটি পূর্ণাঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে স্বয়ং ¯স্রষ্টার কাছ থেকে।
ইসলামী ধর্মগ্রন্থানুযায়ী, এই আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলাম সর্বজনীন ধর্ম। ইসলাম শুধুমাত্র মক্কা-মদিনা বা আরব দেশগুলোর জন্য নয় বরং ইসলাম বিশ্বের সকল বর্ণ, গোত্র, জাতী এবং ধনী-গরীব, সাদা-কালো ও আরব-অনারব সকল মানুষের জন্যই প্রেরিত।
ফোবিয়া অর্থঃ The meaning of Phobia is an exaggerated usually inexplicable and illogical fear of a particular object, class of objects or situation. Phobia occurs in words which refer to a very strong, irrational fear or hatred of people or thing of a particular kind. ফোবিয়ার অর্থ হল বিশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি অতিরঞ্জিত সাধারণত অবর্ণনীয় এবং অযৌক্তিক ভয় এবং ঘৃণা। ফোবিয়া এমন শব্দে ঘটে যা খুব শক্তিশালী, অযৌক্তিক ভয় বা মানুষ বা একটি বিশেষ ধরণের আদর্শবা জিনিসের প্রতি ঘৃণাকে নির্দেশ করে।
ফোবিয়াকে একটি উদ্বেগ জনকপরিস্থিতির প্রতি অবিরাম এবং অত্যধিক ভয় দ্বারা সংঙ্গায়িত করা হয়। ফোবিয়া সাধারণত ভয়ের দ্রুত সূচনা করে। সামাজিক ফোবিয়া অন্য লোকেদের সামনে অপমানিত বা বিব্রত হওয়ার ভয় তৈরি করতে পারে। এই সমস্যাটি হীনমন্যতা এবং কম আত্মসম্মানবোধের সাথেও সম্পর্কিত হতে পারে।
অর্থ্যাৎ ইসলাম ফোবিয়া হলো ইসলাম ও ইসলামের নবী, কুরআন, ইসলামী সংস্কৃতির বিভিন্ন দৃশ্যমান প্রতীক বা চিহ্নকে নিশানা করে কটুক্তি ও ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শণ এবং ঘৃণ ও অপমান জনক বিবৃতি প্রকাশ করে মুসলিম সম্প্রদায় ও ইসলামী বিধিবিধানের প্রতি অনাকাংখিত অ-যৌক্তিক ভীতি-আতংক ছড়িয়ে জন মানুষকে বিভ্রান্ত ও চরম উদ্বেগ তৈরী করে সাধারণ মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে রাখার বিদ্বেষমূলক ও ভীতিকর অব্যাহত পরিবেশ তৈরী করা।
ইসলাম ফোবিয়ার সূত্রপাত হয় খৃস্টীয় শক্তির সাথে মুসলিম অটোমান সালতানাতের সাথে ইউরোপীয় খৃস্টান শক্তি স্বার্থ, রাজ্য বিস্তার, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সময় থেকে ১৯১৪-১৯১৮ সালে সংগঠিত প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে সুদীর্ঘ কালের পরাশক্তি অটোমান সাম্রাজ্য সম্মিলিত ইউরোপীয় মিত্র শক্তির কাছে পরাজিত হলে বিশাল অটোমান সালতানাত ১৯১৬ সনে সাইক পিক্ট চুক্তির মাধ্যমে বানরের রুটি ভাগের মতো বিজয়ী শক্তি নিজেদের মধ্যে ভাগা-ভাগি করে নেয়। এরপর দিকভ্রান্ত মুসলিম জাতিকে সকল ক্ষেত্রে দমিয়ে রাখা, কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র ভাষা ভিত্তিক জাতীয় স্বার্থ কেন্দ্রিক বিভাজন, কোথাও সমূলে বিনাশ করা এবং মুসলিম জাতির আদর্শিক বিশ্বাস আল্লাহ, রাসুল (সাঃ) ও কুরানের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত অপপ্রচার ও ন্যক্কারজনক বিদ্বেস ছড়িয়ে অব্যহত ভাবে আর্থিক, নৈতিক, মানবিক সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মহা পরিকল্পনা নিয়ে উপনেবিশক ইউরোপীয় শক্তি নানবিধ শক্ত তৎপরতায় লিপ্ত থাকে। মুসলিম জাতির হারানো গৌরব, অধিকার, সম্মান মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে ও আত্মিক-ধর্মীয় বুদ্ধি-বৃত্তিক অধোপতনের ( Intallectual Deviation) করুন অবস্থা থেকে ইসলামের কালজয়ী আদর্শের সংস্কার ও পূনর্জীবনের জন্য কতিপয় দূরদর্শী ইসলামী স্কলার শহিদ শেখ হাসানুল বান্না, সাইয়েদ বদিউজ্জামান নূরসী, শহিদ সাইয়েদ কুতুব, ইমাম খামেণী, শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবী, মাওলানা কাশেম নানতুবি, রশিদ আহমেদ গাংগুহি, সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) প্রমুখ সহ আরো অনেক বিদ্যানগণ কঠোর পরিশ্রম ও গবেষণার মাধ্যমে পাশ্চাত্য ঔপনেবশিক শক্তির বিরুদ্ধে ইসলামের সুমহান আদর্শ শিক্ষা মহত্ত¡ উন্নতমানের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সহ অগনিত সাহিত্য সৃষ্টি ও জণগণকে সচেতন করার মানষে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেন। ফলে ব্যাপক সংখ্যক বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মুসলিম পুঁজিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ, নাস্তিক্যবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য অবিশ্রান্ত সতর্ক তৎপরতা চালাতে থাকে। ১৯৪৫ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, ইতালি ও জাপানের অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন একসঙ্গে মোর্চা গড়লেও যুদ্ধ সমাপ্তির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুঁজিবাদী ও সামাজতান্ত্রিক শিবিরের মধ্যকার অবধারিত দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা মাথাচাড়া দেয়। যুদ্ধ শেষে বিশ্ব সামরিক শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যেখানে ছয়টি শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল, যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে সেই জায়গায় প্রধানত দু’টি শক্তির উত্থান ঘটে।
প্রায় ৪৫ বছর ধরে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার কোলে গড়ে উঠা পশ্চিমা পাশ্চত্য বলয় ও কমিউনিস্ট সোভিয়েত রাশিয়া নিজেদের বলয় বৃদ্ধি, ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে ঠান্ডা লাড়াইয়ে (Cold War) লিপ্ত হয়। দুর্দান্ত গতিতে পুঁজিবাদী অর্থ ব্যাবস্থায় ধন তান্ত্রিক মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের ব্যাপক অস্ত্র ও অর্থ কামায়ের দৌড়ে নাস্তিক্যবাদী মতাদর্শের পৃষ্ঠ পোষক সোভিয়েত রাশিয়া অনেকটা পিছিয়ে পরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত কুট কৌশলে আর্থিক ও আদর্শিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আভ্যন্তরিনভাবে দূর্বল করে ফেললে ১৯৯১ সনে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক পাশ্চাত্য ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে মুসলিম বিশ্বের কতিপয় মুসলিম পন্ডিতদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্য তৈরি ও সাংগঠনিক তৎপরতায় মুসলিম জণগনের মধ্যে একটি বিশেষ দল গড়ে ওঠে যারা ইসলামী আদর্শকে আধুনিক জাহেলিয়াতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব মহত্ত¡ সর্বোচ্চ মাত্রায় তুলে ধরে ব্যক্তি সমাজ, রাষ্ট্রের সর্ব পর্যায়ে তা প্রতিষ্ঠিত ও কার্যকরের জন্য দূরদর্শি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলশ্রুতিতে মুসলিম বিশ্বে নতুন করে ইসলামী আদর্শ, সভ্যতা সংস্কৃতি সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়ন, চর্চা অনুশীলন প্রচার-সম্প্রচার শুরু হয়। ইসলামী বিশ্বের আধুনিক শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষায় গড়ে ওঠা তরুন যুব সমাজের কাছে ইসলামী বিধিবিধানের যথার্ততা, আইনের প্রয়োগ, সভ্যতার পরিমার্জিত অবদান, ইসলামী সংস্কৃতির স্বরুপ সম্পর্কে জানা ও বাস্তব জীবনে তা বাস্তবায়নের সুতীব্র আকাংখা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইসলামী জীবনাদর্শের যুগপযোগী ব্যাখ্যা বিশ্লেষন উপস্থাপন এবং তা বাস্তব জীবনের সকল ক্ষেত্রে পরিপালনের মধ্যে দুনিয়া ও পরকালিন জীবনের সুনিশ্চিত উন্নতি ও কল্যাণের প্রাক অতীত উজ্জল ইতিহাস ঐহিহ্যের উদাহরণের প্রভাবে মুসলিম জন মানষে নিরব বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে থাকে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন জাতী গোষ্ঠির কিছু সংখ্যক উচ্চ শিক্ষিত বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় পুরোহিত, ব্যবসায়িক, অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী সহ সাধারণ জণগণের বিরাট অংশ ইসলামের সৌন্দর্য Beauty of Islam) স্বকীয়তা, সহনশীলতা, উদারতা, উত্তম জীবনাদর্শের প্রভাবে পূর্ব ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ বাস্তব জীবনে ইসলামের অনুসরন ও ইসলামী আদর্শ প্রচারের কাজে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। এমতাবস্থায় পশ্চিমা ইসলাম বিদ্বেষী একটি সংগবদ্ধ গ্রুপ ইসলামী পুর্ণজাগরনের সম্ভাবনা ও অনিবার্য বাস্তবতাকে রুখে দেওয়া ও তা ভিন্ন খাতে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য ১৯৮৯ সনে ভারতীয় বংশোদ্ভুদ কথিত মুসলিম নামধারী বৃটিশ নাগরিক সালমান রুশদির মাধ্যমে “স্যাটানিক ভার্সেস” The Satanic Verses নামক চরম ইসলাম ও নবী (সাঃ) বিদ্বেষী বই রচনা করাইয়া বাজারজাত করলে মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক ঘৃণা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে। স্বাভাবিক ভাবে প্রত্যেক মুসলিমের হৃদয়ে প্রচন্ড আঘাত লাগে ফলশ্রুতিতে কিছু-কিছু স্থানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ায় মিছিল, প্রতিবাদ, মানববন্ধন ও ভাংচুর হয়। কিছু আবেগী ও অর্বাচীন সুমলিম সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করে। এটাকে ইসলাম বিদ্বেষী পর্দার অন্তরালে ঘাপটি মেরে বসে থাকা গ্রুপটি ইসলাম ফোবিয়ার টেস্ট কেস হিসাবে প্রচারনা চালনার মোক্ষম সুযোগ নেয়।মুসলিম ও ইসলামী আদর্শ বিরোধী একটি গ্রুপ কতিপয় আবেগী মুসলিমদের কিছু অসহিষ্ণু কার্যক্রমকে গোটা মুসলিম জাতিকে মৌলবাদী জঙ্গী সন্ত্রাসী বলে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়।
১৯৮৯ সালে স্নায়ু যুদ্ধের পরে এবং সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রাজ্যের পতনের পরে একমাত্র পরাশক্তি বিশ্বে ওয়াশিংটন কেন্দ্রিক সমমনাদের সমন্বয়ে সংগঠিত থিংক ট্যাংকের মাধ্যমে রচিত হয় নতুন আমেরিকান শতাব্দী প্রকল্প (Project for The New American Century- PNAC)। এই প্রকল্পে একুশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক সামাজ্য তৈরির কথা বলা হয়েছে। এই সাম্রাজ্য ভেটো ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৯১ সালে আমেরিকা একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার সৃষ্টি ঘোষনা দেয় A New World Order সেই বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা কিভাবে করা যায় এবং এই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখা যায়, তার পথ নির্দেশ করলে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রাষ্ট্র বিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন Samuel P. Huntington ১৯৯৩ সালে তার লিখিত ৩২০ পৃষ্ঠার Clash of Civilization and the Re-Making of World Order গ্রন্থে তিনি বললেন, ১৯৯০ সাল থেকে সমাজতন্ত্রের পতনের পর তথ্যপ্রযুক্তির অভাবিত অগ্রগতির ফলে এবং বিশ্বময় বাজার অর্থনীতি ও উদারনৈতিক গণতন্ত্রের একালে জাতি রাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস পাবে। অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অবাধ আদান- প্রদানের ফলে জাতিরাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমে ম্লান হতে থাকবে এবং বিশ্ব ক্রমাগতভাবে পশ্চিমাভিমুখী হবে। ফলে তখন সংঘাত দেখা দেবে সভ্যতার মধ্যে। জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে নয়। তিনি আরও বলেন, বড় আকারের সংঘাত ঘটবে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও প্রাচ্যসভ্যতার মধ্যে, বিশেষ করে ইসলামী বিশ্ব ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে। তিনি তাঁর উক্ত বইতে বৌদ্ধ, সনাতন হিন্দু, ইয়াহুদী, ইত্যাদি সভ্যতার কথা আলোচনা করলেও ইসলামী সভ্যতার সাথে পাশ্চত্য সভ্যতার মূল দ্বন্ধের কুট-কৌশলী বৈষম্যমূলক মতবাদ সামনে নিয়ে আসে। ফলে পাশ্চাত্যের কিছু গোঁড়া অন্ধ ইসলাম বিদ্বেষী কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় পন্ডিত, বিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ইসলামের মূল বিশ্বাসের জায়গাগুলোতে ক্রমাগত আঘাত করে মুসলিম বিশ্বের কিছু কিছু মানুষকে উত্তেজিত ও সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ করে ইসলাম ও নবী করিম (সাঃ) সম্পর্কে ভীতি এবং ইসলাম ফোবিয়া তৈরিতে সুক্ষ্মতি-সুক্ষ পদক্ষেপ নেয়। যাতে মানব জাতীর মধ্যে ইসলামের সুমহান প্রভাবশালী আদর্শের প্রভাব বাধাগ্রস্থ হয়। এভাবে হান্টিংটন “সাংঘর্ষিক ইসলামকে” Militant Islam ইউরোপকেন্দ্রিক সভ্যতা, বিশেষ করে আমেরিকার প্রতিপক্ষরুপে দাঁড় করিয়েছিলেন। ঐ বইতে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, সমাজতন্ত্রের অবলুপ্তির পর বিশ্বে সংস্কৃতি এবং সভ্যতার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করেই সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব হবে।
হান্টিংটন তার বিখ্যাত বইয়ে বিশ্বে অনেকগুলো সভ্যতার মধ্যে বিভাজিত করলেও পশ্চিমা ও ইসলামীকে বিশ্বে মধ্যকার সংঘাতকেই অধিক সম্ভাব্য বলে রায় দিয়েছেন। তিনি লিখিছেন, ইসলামী চিন্তা-চেতনার পুনরুত্থান, বিশ্বে ব্যাপী মুসলমান ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যার লক্ষণীয় বৃদ্ধি এবং পশ্চিমা সভ্যতার একচেটিয়া আধিপত্যের সমন্বয়েই মুসলিম মৌলবাদ বিকশিত হওয়ার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরও লিখেছেন, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের বিশ্বাসের মধ্যে ধর্মান্তরের অভিন্ন প্রতিযোগিতাও বিদ্যমান। মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের মধ্যকার বিবাদের ইতিহাসও হাজার বছরেরও অধিককালের। সংঘাতের এসব উপাদান বিবেচনায় নিয়ে স্যামুয়েল হান্টিংটন ইসলামী বিশ্বকেই কমিউনিজম- পরবর্তী পশ্চিমাদের প্রধানতম শত্রু সাব্যস্ত করেছেন। ২০০১ সালে এক রহস্যময় অত্মঘাতি বিমান হামলায় টুইন টাওয়ার বিধ্বস্ত হলে অধিকাংশ পশ্চিমা জনগোষ্ঠির ভেতর যে ভয়ঙ্করভাবে সাম্প্রদায়িক ইসলাম ফোবিয়ার বিস্তার ঘটেছে, তার তীব্রতা হান্টিংটন তত্তে¡র ভবিষ্যদ্বাণীকেও অতিক্রম করে গেছে।
মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার খর্ব Deprived of Rights করার জন্য হতাশা সৃষ্টি ও উগ্রবাদ জন্মে। তাদের মধ্য থেকেই চরম পন্থার সৃষ্টি হয়। সিরিয়া, ফিলিস্তিনসহ অন্যান্য যায়গায় যে চরমপন্থা, উগ্রবাদ দেখা যায় তার মূলে রয়েছে মুসলিমদেরকে নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখার অপকৌশল। কোনঠাষা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে চরম হতাশার কারণে চরম পন্থার সৃষ্টি হয়। ইসলামে রেডিকাল ইসলাম বলতে কিছু নেই। হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান কোন ধর্মেই চরম পন্থার স্থান নেই। সকল ধর্মেই সহানুভুতি ও ন্যায় বিচারের কথা রয়েছে। ৯/১১ এর পরে ইসলামকে সন্ত্রাস এর সাথে মিলিয়ে ইসলাম সম্পর্কে গোটা বিশ্বের মানবজাতিকে ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি তথা ইসলাম ফোবিয়ার রং লাগিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ ছিল আত্মঘাতি বোমা হামলা। ৯/১১ হামলার কারণে ইসলাম ফোবিয়ার উদ্ভব তীব্র আকার ধারণ করে। কারণ মুসলমানেরাই ঐ টুইন টাওয়ারে আত্মঘাতি হামলায় Suicide Bombing জড়িত ছিল। মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি অংশ মনে করতো এ পন্থায় তারা জান্নাত পাবে এমনকি অনেক নারীও আত্মঘাতি হামলায় জড়িত ছিল। তখন এক অদ্ভুত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক (War Against Terror Project)ঘোষণার পরে পৃথিবীর যেখানেই আত্মঘাতি হামলা সংগঠিত হতো কোন প্রকারের যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঢালাও ভাবে ইসলামের অনুসারী মুসলিম সম্প্রদায়কে টার্গেট করে আত্মঘাতি হামলার জন্য সন্দেহজনক ভাবে মুসলমানদেরকেই দোষারোপ করে ইসলাম ফোবিয়ার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমরা মুসলিম সম্প্রদায়ের কেউ আত্মঘাতি বোমা হামলার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই সে বিষয়ে পশ্চিমাদের কাছে ব্যাখ্যা করিনি। আত্মঘাতি হামলাকে ইসলামের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ আমরা কেউ গবেষণা করিনি যে, ৯/১১ এর আগে অধিকাংশ আত্মঘাতি হামলা শ্রীলংকার হিন্দু তামিল টাইগাররা করেছে। কিন্তু তাদেরকে হিন্দু সন্ত্রাসী, জঙ্গী বা মৌলবাদী বলা হয় নাই। হিন্দুত্ববাদের সাথে আত্মঘাতি হামলার কোন সম্পর্কও নাই কিন্তু পশ্চিমাদের সামনে ইসলামের প্রকৃত স্বরুপ কথিত মুসলমান সম্প্রদায় তুলে না ধরার জন্য ইসলাম সম্পর্কে ইসলাম ফোবিয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। জাপানেও বৌদ্ধদের দ্বারা আত্মঘাতি হামলা হয়েছে কিন্তু সেখানে বৌদ্ধ সন্ত্রাসী বা বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো হয় নাই।
পশ্চিমাদের মূল সমস্যা ধর্মকে ইসলামের মত করে ভাবে না বা দেখে না। এ কারণে পশ্চিমারা ইসলামকে অসহনশীল ধর্ম হিসাবে গণ্য করে। সেখানে বাক স্বাধীনতার প্রশ্রয় দেয়া হয় না, নারীদের অসম্মান করে, মুক্ত জীবন-যাপন ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অন্তরায়। কিছু দিন পর-পর ইসলাম সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করার ফলে মুসলিম বিশ্বে প্রতিবাদ প্রতিক্রিয়া শুরু হয় তারপর ইসলামকে অসহনশীল ধর্ম বলে চিহ্নিত করে। পশ্চিমা জণগনের একটি নির্দিষ্ট অংশ ইসলাম সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করার ফলে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা জানা স্বত্ত্বে ও সচেতন ভাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে আঘাত, অপমান ও উত্তেজিত করার ন্যাক্কারজনক কাজ করতে কখনও দ্বিধা করে না। বিশেষ করে কুরান ও নবী করিম (সাঃ) সম্পর্কে অরুচিশীল, গর্হিত মন্তব্য করে মুসলিম কমিউনিটিকে অব্যাহত আঘাত করে। কিন্তু আমাদের মুসলিম নেতৃবৃন্দ বা ইসলামিক স্কালরগণের কেউই আমাদের নবী করিম (সাঃ) এর সম্মান মর্যাদা, মহত্ব (Tremendous Degnity) সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেনি পশ্চিমাদের সামনে। আমাদের উচিত ছিল তাদের কাছে তুলে ধরা আমাদের নবী আমাদের কাছে কতোটা গুরুত্বের। তারা বুঝতে পারে না আমাদের নবী আমাদের কাছে কতোটা গুরুত্ব ও সম্মানের। আমাদের নবী আসমানী গ্রন্থের চাক্ষুষ প্রমাণ। পবিত্র কুরান মুসলিমদের পথ-প্রদর্শক আমাদের নবী এই কুরানের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। কুরান আমাদের যা নির্দেশ করে তিনিই ছিলেন তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি হলেন নেই নবী যার মত আমরা সবাই হতে চাই।
তিনি হলেন আমাদের হৃদয়ের গভীরে চিরন্তন স্থান করে রাখা মহামানব। তার সম্মান-মর্যাদা, মহাত্ব রক্ষা করার জন্য আমরা সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে সতস্ফুর্ত প্রস্তুত থাকি। তিনি মদিনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটাই ইসলামের প্রথম রাষ্ট্র। এটি ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি (Pillars of Islamic Civilaization)। এই আদর্শিক রাষ্ট্রের আইন ও ন্যায় বিচারের উপর নির্ভর করেই মুসলিম বিশ্ব প্রায় সাঁতশত বছর ধরে বিশ্বে বিরাট একটা অংশ পরিচালনা করে এবং মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রটিই ছিল পৃথিবীর প্রথম কল্যানমূলক রাষ্ট্র।
প্রত্যেক মুসলমান রাসুলে করিম (সাঃ) কে তার আপন পিতা-মাতা, স্ত্রী, পুত্র পরিজন, ধন-সম্পদ, সব কিছুর চাইতে বেশী ভালবাসে, অগ্রাধিকার দেয়, তার নির্দেশ পালনে সদা প্রস্তুত থাকে। নিজের জীবনের চাইতেও তাকে বেশী শ্রদ্ধা করে ও ভালবাসে। এ প্রসঙ্গে হাদিস গ্রন্থ বুখারি ও মুসলিম শরীফে বর্ণনা এসেছে-
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে খোদা (সাঃ) বলেছেন, ততোক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের কেউ পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতোক্ষন না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি এবং সমস্ত মানুষের তুলনায় অধিক প্রিয় হই। (বুখারী-মুসলিম)।
পবিত্র কুরানের সূরা আল-ইমরানের ৩১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “হে নবী তুমি লোকদের বলে দাও “তোমরা যদি আল্লাহর ভালবাসা পেতে চাও তাহলে আমার (মুহাম্মদ-সাঃ) কে ভালোবাস, আনুগত্য কর তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভাল বাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ্ মাফ করে দিবেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুনাময়”।
রাসুল (সাঃ) এর বর্ণনা মতে তার সমস্ত স্ত্রী গণ আমাদের মায়ের সমতুল্য। আমাদের আদর্শিক বিশ্বাসের স্তম্ভ গুলো ১)আল্লাহ্, ২) ফেরাস্তা সমূহ ৩) আমাদের জীবন পরিচালনার পবিত্র সংবিধান আল-কুরান ৪) রাসুল (সাঃ) আমাদের সর্বাধিক ভালবাসা ও শ্রদ্ধার মহামানব ৫) রাসুল (সাঃ) এর সমস্ত স্ত্রী গণ আমাদের মায়ের সমতুল্য। এ বিষয় গুলো আমাদের হৃদয় মন ও আত্মার চেতন অবচেতন স্তরে প্রবেশ করে আছে। এ গভীর বিশ্বাস কোমল ও সু² এক মনোরম রেশমী রজ্জু দ্বারা আবদ্ধ। আমাদের অন্তর্মধ্যস্ত মাধ্যাকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু।
পশ্চিমা পুঁজিবাদী ও নাস্তিক্যবাদী ধ্বজাধারী ভয়ংকর ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠি উপরোক্ত স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে হেয় প্রতিপন্ন, অপমান সুচক, মর্যাদাহানী, বিশেষ করে রাসুল করিম (সাঃ), এর শ্রেষ্টতম ও সুউচ্চ চরিত্রের উপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া, ইসলামী সংস্কৃতির দৃশ্যমান রুপ ইসলামী পোশাক, দাড়ি, টুপি, ইসলামী বিঁধি-বিধান কে নিশানা বানিয়ে মারাত্মক অশ্লিল, আপত্তিকর ও অশ্রদ্ধাশীল কথা ও কর্মকান্ড বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে দিয়ে গোটা মুসলিম জাতীর হৃদয়, মন-মননে চরমভাবে আঘাত করে ইসলামকে এক ভয়ংকর বিপদ রুপে পশ্চিমা জনগণের কাছে হাজির করে।ইসলাম ও মুসলিমদের সভ্যতা ধ্বংসকারী এবং একদল যুক্তিহীন বিশ্বাসী মানুষের সমস্ত জীবনের কর্মকান্ড হিসাবে চিত্রিত করে। এর অনিবার্য কারণ হিসাবে মুসলমানদের হৃদয়ের অন্তর্স্থলে রক্তক্ষরণ ও পশ্চিমাদের প্রতি প্রচন্ড ক্ষোভ, হিংসা, বিদ্বেষের, বহিঃপ্রকাশ ঘটে পশ্চিমা দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে, স্থাপনা ও জণপদে সহিংস প্রতিক্রিয়া ও আত্মঘাতি হামলার মাধ্যমে। এটাকেই তারা প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ, সন্ত্রাসী রুপে ইসলামের সাথে রং লাগিয়ে ইসলাম ফোবিয়ায় গুলিয়ে ফেলে যা বড়ই আমাদের জন্য দূর্ভাগ্যের কারণ। মুসলমানদেরকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অপদস্ত, অপমানিত করা হয়, তাদেরকে দেখলেই সন্ধেহভাজন, ভীতি সঞ্চারকারী, উগ্রবাদী, অন্ধকার গুহায় বসবাসকারী, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার অন্তরায় হিসাবে চিত্রায়ন করা হয়। যাতে পশ্চিমা জনগণ ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে মত বিনিময় বন্ধুত্ব, যোগাযোগ বা পাশাপাশি বসবাসের ইচ্ছা থেকে সযতনে এড়িয়ে চলে। এরই ধারা বাহিকতায় ইতিমধ্যে ইসলাম ফোবিয়ার আরেকটি নতুন উপসর্গ (Hate Crime) লক্ষ করা যাচ্ছে আমেরিকা, জার্মান, ফ্রান্স, গ্রীস, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ইত্যাদি দেশগুলোতে।
ইদানিং ইসলাম ফোবিয়ার সম্প্রসারিত স্থান হিসাবে বাংলাদেশেও গোচরে আসতে শুরু হয়েছে। ইসলাম ও ইসলামী সংস্কৃতির বিভিন্ন নিদর্শন সম্পর্কে কটুক্তি ও হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০১৩ সালে সরকারের নিরাবতায় ইসলাম বিদ্বেষী কিছু মিডিয়ার সহায়তায় দেশীও নাস্তিক্যবাদী ইসলাম বিদ্বেষী ক্ষুদ্র গ্রুপের সল্প সংখ্যক কুবুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক বাম ঘরনার রাজনীতিবীদ সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় যুক্ত আছে। লক্ষ্য একই বাংলাদেশে ইসলামের জয়যাত্রকে রুদ্ধ করা। ইসলাম বিদ্বেষী মিডিয়ার সমর্থনকারী ও মালিকরাই শাহবাগে নবী করিম (সাঃ) এর উন্নত ও নিষ্কলুশ অমলীন চরিত্র সম্পর্কে কুৎসা রটনা করে নতুন করে ইসলাম ফোবিয়ার সূচনা করে। ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগারদের পৃষ্ট-পোষকতা ও সুযোগ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে বিরাট একটা নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে যা বর্তমানেও চলমান রয়েছে।স্বাধীনতা বিরোধী, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, রাজাকার ও আলবদর অপশক্তি বলে বিদ্রুপ ও তিস্কারের কথা সামনে আনলেও মূলত তারা ইসলাম, ইসলামী সংস্কৃতি, তাহজীব তমুদ্দিন ও মুসলমানদের মূল বিশ্বাসের স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত করে ইসলাম ফোবিয়া বা ইসলাম আতঙ্কের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে সুকৌশলে। মিডিয়ার বীভৎস মুখ এঁকে মাথায় চাঁদ তারা খচিত টুপি এবং থুতনিতে দাড়ি দেখানো হচ্ছে। অথচ এগুলো ইসলামী সংস্কৃতির চিহ্ন। তাদের এই অপকৌশল গুলি এখনই রুখে দেয়ার সময়। অন্যথায় বড় বিপর্জয়ের সূচনা হবে।
৯/১১ এর পরে যুক্তরাষ্ট যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তার অধিকাংশের লক্ষবস্তু ছিল মুসলিম জনপদ, ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশ-কে এতটাই উত্তেজিত করেছিল যে নিজেই আবেগে ক্রুসেড (Crusade) বা ধর্ম যুদ্ধের কথা উচ্চারণ করেছিল। যদিও পরবর্তিতে তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন। তার পরবর্তি ঘোষণা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (War Against Terrorism)| এই যুদ্ধে সামিল হয়েছিল কিছু মুসলিম রাষ্ট্র এবং সহায়তাও করেছিল। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কয়েকটি আমেরিকার ইসলাম ফোবিয়ায় কাতর অভিযানে অংশ নিয়েছিল শুধুমাত্র আত্ম রক্ষার প্রয়োজনে নইলে পরাশক্তি আমেরিকার রোষানলে পড়ে যুদ্ধের আঘাতে জর্জরিত ও স্বাধীনতা হারানোর ভয় ছিল।
পোল্যান্ডের লিওপোল্ড উইস, যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে খ্যাতনামা মুসলিম বিশেষজ্ঞে পরিণত হন, তার মতে খ্রিস্টান ইউরোপ মুসলিম বিশ্ব ক্রুসেডের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে আবেগজনিত প্রচন্ড আঘাতের অভিজ্ঞতা কোনো দিন ভুলতে পারেনি। কেননা, তা তো স্বাভাবিক। ছেলেবেলায় আহত হওয়ার বেদনা সারাজীবন তাকে তাড়া করে ফেরে। যখনই সুযোগ পায়, তখনই অতীত স্মৃতি তাকে সেই আঘাত স্মরণ করিয়ে দেয়। এমনি বক্তব্য রেখেছেন তার অত্যন্ত প্রসিদ্ধ বই The Road to Mecca -তে। তিনি মুসলিম নাম ধারণ করে হয়েছেন মুহাম্মদ আসাদ।
এই প্রসঙ্গে, বিশেষ করে War against Terror প্রসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সুসন্তান Edward W Said বলেছেন: This is the stupidest and most recklessly undertaken war in modern times. It is all about imperial arrogance, unschooled in worldliness, unfettered either by competence or experience,
underterred by history of human complexity unrependant in brutal violence and cruel electronic gadgetry.
ইসলামের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষিত হয়েছে, তার মোকাবিলা করবেন মুসলমানরাই। বিশ্বময় তারা শুধু সংখ্যায় নয়, বেড়ে চলেছেন জ্ঞানে, গুণে, মননে, অভিজ্ঞতায়। সুতরাং War against Islam কখনো সফল হতে পারে না। সাময়িকভাবে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে শুধু। এর পরে এ সম্পর্কে অন্য কোন বিবরণ বা ব্যখ্যার প্রয়োজন নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা খৃস্টান শক্তি, ইয়াহুদী এবং ব্রাক্ষন্যবাদী ভারতের ত্রাদেশীয় তল্গীবাহক ইসলাম বিরোধী সবার কাছে ইসলাম জঙ্গিবাদের নামান্তর। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ইসলামী চিন্তাবিদদের অতি সাবধানে পা ফেলতে হবে। এমন পরিবেশে বাংলাদেশে ইসলাম আক্রান্ত হলেও, জনগণের শিক্ষা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, হা না মানার মন মানসিকতা, জ্ঞান-অন্বেষণের আকুতি বাংলাদেশের আকাশে যে কালো মেঘের ঘনঘটা তা দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তবেই ইসলাম ফোবিয়া ভয়াবহ অপপ্রচার ও কথিত আতঙ্ক ভীতিকর পরিবেশ থেকে বাংলাদেশ পরিত্রাণ পাবে
লেখক: মোঃ রেজাউল ইসলাম রেজা
এ্যাডভোকেট
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ঢাকা।